তন্দ্রা চাকমা: তাইন্দং মাটিরাঙ্গা, সাবা এবং কিছু অনূভুতি

তাইন্দং মাটিরাঙ্গা, সাবা এবং কিছু অনূভুতি

তন্দ্রা চাকমা

ঘটনাটা ঘটেছিল ৩রা আগষ্ট ২০১৩ তে। প্রথম জেনেছিলাম ফেসবুকের মাধ্যমে। কি ঘটেছিল?  বিডি নিউজ ২৪ এর মাধ্যমে জানা যায়: গত ৩ অগাস্ট মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং এর ক্রসিং এলাকায় কামাল নামে এক বাঙালিকে  অপহরণরের  গুজব ছড়িয়ে পড়ার ঘণ্টা-দুয়কেরে মধ্যে একদল বাঙালি সংঘবদ্ধ হয়ে কয়কেটি গ্রামে হামলা চালায়। ওই হামলায় ৩৫টি বাড়ি ও একটি বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হয়। ভাংচুর করা হয় আরো প্রায় তিন শতাধিক বাড়ি, লুটপাট করা হয় মূল্যবান সামগ্রী ও টাকা।

প্রায় ৪০০ পরিবার কাছের ভারতীয় সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়। সাড়ে তিনশ পরিবার চলে যায় পাশের পানছড়ি উপজেলার আত্মীয়দের আশ্রয়ে বাকিরা জঙ্গলে। পরদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার নো ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া পাহাড়িদের আশ্বাস দিলে তারা বাড়িতে ফিরে আসেন। নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা জোরদার হওয়ায় অন্যরাও বাড়ি ফিরতে শুরু করেন।

উপরের নিউজ থেকে এটুকু পরিস্কার সম্পূর্ন এক গুজবকে কেন্দ্র করে এ অমানবিক ঘটনা ঘটে। এরপরে ঈদের ছুটি হওয়ার কারনে বিষয়টি খবরে আসেনি মানে মিডিয়াতে আসেনি। ঈদের পরপরই বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মী ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে নাগরিক কমিটি গঠিত হয় মাটিরাঙ্গায় আক্রান্ত মানুষদের সহায়তার জন্য। এ কমিটি প্রথম সফরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করে সহায়তার লক্ষ্যে। এ লক্ষ্যে নাগরিক কমিটি প্রথমবার বিভিন্ন প্র্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিযার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে টিম গঠন করে মাটিরাঙ্গা সফর করে ও বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিবেদন ছাপানো হয় ।

সেপ্টেম্বরের ২৬-২৭ তারিখ আমি নাগরিক কমিটির সাথে মাটিরাঙ্গা যাই। সেই কথাতেই আসি। আমরা ২৬ তারিখ খুব ভোরে রওনা দেই। পথে বেশ কয়েকবার যাত্রা বিরতি হযেছিল। আমার সফরসঙ্গী হিসাবে ছিলেন আনিস মাহামুদ ফটোগ্রাফার, রাজীব মীর অধ্যাপক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, রাশেদ রাইন ফিল্ম মেকার, আফরোজা সোমা সাংবাদিক, উছা চাক আই এলও প্রতিনিধি, আমি, বায়জিদ হাসান সাংবাদিক ৭১ টিভি ও ফটোগ্রাফার অংমাছাই চাক। আমরা প্রায় ৪ ঘন্টা ধরে যেতে যেতে পৌঁছে গেলাম বগা পাড়া বুদ্ধ মন্দিরের সামনে। পথে থামতে হয়েছে ঝর্না টিলা আর্মি কাম্পে। আমরা বুদ্ধ মন্দিরের সামনে যখন পৌছালাম তখন সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন রিলিফ কমিটির বকুল বাবু ও অন্যান্যরা। কয়েকজন পাড়াবাসীর সাথে কথা হল কি ঘটেছিল তা জানার জন্য। উনাদের মধ্যে একজন বললেন ঘটনার দিন সেটেলাররা কয়েকজনকে মারধোর করে তার মধ্যে উনিও ছিলেন। উনার হাতে তখন ও মারের কালশিটে দাগ ছিল শরীরে। উনি বলছিলেন সেদিন মারের আতংকে উনারা ভারতীয় সীমানার নো মেনস ল্যান্ডে গিয়েও মারের হাত থেকে রেহাই পাননি। শুধু একটা গুজবের উপর ভিত্তি করে এত তাণ্ডব। একফাকে একটা স্কুলগামী ছেলের সাথে কথা হচ্ছিল যে বলছিল তারা আতংকের কারনে স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে। স্কুলে বন্ধুদের সাথে পড়া ও খেলা কার না ভাল লাগে। সেই ছেলেটির ও তাই কিন্তু ভয় কাটছে না বলে যেতে পারছে না। ওর এই ভয় কাটানোর দায়িত্ব আসলে কার? এই দায়িত্ব ওখানে নিরাপত্তা রক্ষার কাজ যাদের তাদের সবার। কিন্তু সেটা কি তারা ভাল ভাবে করবেন? এই সব ভাবনা নিয়ে আমারা মন্দিরের  সামনে মাচার ঘরে রিলিফ বিতরণ শুরু করলাম। প্রথমে দেওয়া হল মানুষের জন্য ফাউন্ডশনের ৫ লক্ষ টাকা এরপর নাগরিক কমিটি ও কাপেং ফাউন্ডশনের সাড়ে ৭ লাখের বেশি টাকা। এই টাকা বিভিন্ন সহানুভুতিশীল মানুষ দিয়েছেন তাইন্দং এর ক্ষতিগ্রস্তদের । এই সবের ফাকে আমাদের দুপুরের খাবার ও তাড়াতাড়ি খাওয়া হল। এত কষ্টের মাঝেও তাইন্দং বাসী আমাদের আপ্যায়ন করতে ভুলেন নি। এটা হল উনাদের আন্তরিকতা। সব দায়িত্ব শেষ করে ফেরার পথে আমরা ওই এলাকার বিজিবি কমান্ডারের সাথে কথা হল। উনি বললেন ঘটনার পর থেকে নিরাপত্তার দায়িত্তে উনারা আছেন। উনি বলছিলেন এলাকার পাহাড়িরা উনাদের কম বিশ্বাস করেন। তখন বললাম বিশ্বাস স্থাপন করা যে কোন মুল্যে উনাদের করতে হবে। এর আগে এভাবে বিশ্বাস স্থাপন হয়নি। সবসময় ক্ষতি গ্রস্থদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়েছে  তাই এই অবস্থা। তবে উনি বললেন চেষ্টার কমতি হবে না। যাক উনার কথামত হলেই হল। গাড়িতে উঠার পর দেখলাম অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ চালের বস্তা নিয়ে ফিরছে। জিজ্ঞেস করে জানা গেলও প্রতি কেজি ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে প্রশাসনের পক্ষা থেকে। আরও কিছুদুর আসার পর আমরা একটা পুড়ে যাওয়া বাড়ি দেখতে পেলাম। সেখানে থামা হল ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি দেখার জন্য। বাড়ির চারপাশের তাজা আমগাছের পুড়ে যাওয়া দেখলে বুঝা যায় বাড়ি ও এর আশপাশ গান পাউডার ও পেট্রোল ঢেলে পোড়ানো হয়েছে। এই বাড়িতে এক মাসের শিশু সাবার (চাকমা নাম) সাথে দেখা হল। সাবা মানে ছায়া। উছা চাক এর মতে এই সাবা বেচে থাকলে একদিন এই অভাগা মানুষদের ছায়া হয়ে কাজ করবে ও প্রশান্তি আনবে। সাবার মা সুবর্ণা চাকমা সেই ৩ তারিখে তিনি সাবাকে পেটে করে ভারতের নো মেনস ল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন উছা কে। এত বড় ভারি পেট নিয়ে আছাড় খেলে তার ও তার সন্তানের ক্ষতি হতে পারত। উপরওয়ালার কৃপায় সে রকম কিছু হয় নি। ভারত থেকে ফেরার কিছুদিন পর সাবার জন্ম হয়। মাটিরাঙ্গায় এই ধরণের অনেক উপন্যাসের অধ্যায় আছে যা আসলেই বেদনার।

Ucha Chak with the new born baby Saba Chakma. Photo courtesy: Bayezid Hossain
Ucha Chak with the new born baby Saba Chakma. Photo courtesy: Bayezid Hossain

২৭ তারিখ যাওয়ার পথে তাইন্দং এর রূপে আমরা পাগল হতে পারিনি। পারিনি সেই মাটির আর সবুজের রূপ উপভোগ করতে। এই ক্ষত আমাদের বার বার প্রশ্ন করছিল আমাদের মত দেশে কেন এটা হবে? কেন স্কুলের শিশুরা স্কুলে যেতে ভয় পাবে? কেন সাবার বাড়ি পুড়ে ছাই হবে। কেন সাবা শিশুকাল থেকে আর সব শিশুদের মত বড় হবে না? তাকে কেন পলিথিনের চাল দেওয়া পোড়া বাড়িতে বড় হতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই।

2 thoughts on “তন্দ্রা চাকমা: তাইন্দং মাটিরাঙ্গা, সাবা এবং কিছু অনূভুতি

  1. ২৭ তারিখ যাওয়ার পথে তাইন্দং এর রূপে আমরা পাগল হতে পারিনি। পারিনি সেই মাটির আর সবুজের রূপ উপভোগ করতে। এই ক্ষত আমাদের বার বার প্রশ্ন করছিল আমাদের মত দেশে কেন এটা হবে? কেন স্কুলের শিশুরা স্কুলে যেতে ভয় পাবে? কেন সাবার বাড়ি পুড়ে ছাই হবে। কেন সাবা শিশুকাল থেকে আর সব শিশুদের মত বড় হবে না? তাকে কেন পলিথিনের চাল দেওয়া পোড়া বাড়িতে বড় হতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই।…….আমরাও জানি না এই হতভাগ্য মানুষদের ভাগ্য কবে ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কি না। তাদের জন্য আমাদের মনে করূনা জাগলেও যেন চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই।

    1. ধন্যবাদ পড়ার জন্য । আপনি আমার সফরসঙ্গী ছিলেন । দেখেছেন নিজের চোখে আশা করি অনেক কিছু ধারনা করতে পেরেছেন।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s