আনু মুহাম্মদ: আরেকটি সর্বনাশা চুক্তি

আরেকটি সর্বনাশা চুক্তি
আনু মুহাম্মদ for Alal O Dulal

দেশের ভবিষ্যৎকে বিপদাপন্ন করে আরেকটি সর্বনাশা চুক্তি করলো সরকার। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন খুশি, কিন্তু বিপদাপন্ন বাংলাদেশ। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সংশোধিত ‘পিএসসি ২০১২’ অনুযায়ি সরকার ভারতের অয়েল এ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন (ওএনজিসি বিদেশ) এবং অয়েল ইন্ডিয়ার সাথে বঙ্গোপসাগরের এস এস ৪ ও এসএস ৯ নামে চিহ্নিত ২টি গ্যাসব্লকের চুক্তি সম্পাদন করেছে। এর মাধ্যমে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা বঙ্গোপসাগরের এই দুটো ব্লকের প্রায় ১৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার গ্যাস তেলসহ খনিজ সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করলো। আগামী ৮ বছরে এই দুই ব্লকে অনুসন্ধান কাজে তারা মোট বিনিয়োগ করবে প্রায় ১৪ কোটি ডলার, টাকার অংকে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা। কিন্তু সম্পদের শতকরা গড়ে প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি মালিকানা থাকবে তাদের। একই ধারায় এই মাসের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের কনকো-ফিলিপসের সাথে ৭ নং গ্যাস ব্লক নিয়ে সরকার আরও ১টি চুক্তি করতে যাচ্ছে।

এর আগে পিএসসি ২০০৮ এ রফতানির বিধান নিয়ে আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম, জনপ্রতিরোধ ও জনমতের চাপে পিএসসি ২০১২ তে রফতানির বিধান রাখা হয়নি। এটি জনগণের আন্দোলনের বিজয় বলে আমরা মনে করি। কিন্তু বর্তমান দলিলে অনেকগুলো চালাকি করা হয়েছে। পরে বিদেশি কোম্পানিগুলোর দাবির কাছে নতি স্বীকার করে সরকার পিএসসি ২০১২ সংশোধন করে। সংশোধিত পিএসসি ২০১২-তে বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য অবিশ্বাস্য সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। তাদের কথামতো চুক্তির দলিল বা ‘পিএসসি’ সাজানোর পর তারপর টেন্ডার আহবান করা হয় এবং আগে থেকে ঠিকঠাক করা কোম্পানিগুলো তাতে সাড়া দেয়। ভারতের ওএনজিসি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কনকো ফিলিপস এখন তালিকায়। এছাড়া লাইনে অস্ট্রেলীয় ও চীনা কোম্পানিও আছে।

কোম্পানিগুলোর উচ্চ মুনাফা ও কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে সংশোধিত পিএসসিতে যেসব বাড়তি সুবিধা নতুন করে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে আছে প্রথমত, গ্যাসের ক্রয়মূল্য, অর্থাৎ বাংলাদেশ যে দামে গ্যাস কিনবে তার দাম, আগের চুক্তির ২.৯ মার্কিন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৬.৫ মার্কিন ডলার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে শতকরা ১২৪ ভাগ। দ্বিতীয়ত, প্রতিবছর গ্যাসের দাম শতকরা ২ ভাগ হারে বৃদ্ধির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তৃতীয়ত, ব্যয় পরিশোধ পর্বে বিদেশি কোম্পানির অংশীদারিত্ব, গভীর সমুদ্রের ব্লকের জন্য, শতকরা ৫৫ ভাগ থেকে বৃদ্ধি করে শতকরা ৭০ ভাগ করা হয়েছে। চতুর্থত, ইচ্ছামত দামে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

মনে রাখা দরকার যে, বঙ্গোপসাগরের গ্যাসসম্পদ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানী নিরাপত্তার প্রধান অবলম্বন। অথচ এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাহীন করে, বিদেশি কোম্পানিকে এত বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে যে, নিজ দেশের গ্যাস সম্পদ কেনার ক্ষমতা বাংলাদেশের থাকবে না, কিনতে গেলে ভয়াবহ আর্থিক বোঝার সম্মুখিন হতে হবে। এছাড়া একাধিক ব্লকে গ্যাস পাওয়া গেলে যোগান এতোবেশি হবে যে, রফতানি তখন অনিবার্য হয়ে উঠবে। সেজন্য দলিলে গ্যাস রফতানির উপর কোন নিষেধাজ্ঞা রাখা হয়নি, ৪ বছর আগে সংসদে উত্থাপিত ‘খনিজ সম্পদ রফতানি নিষিদ্ধ আইন’ও পাশ করা হয়নি। এসব ব্লকে কর্তৃত্ব রাখার অজুহাতে রাজনৈতিক সামরিক মহড়াও যুক্ত হবে। নিজের দেশের গ্যাসসম্পদ পরিণত হবে গলার ফাঁসে, জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখিন হবে।

পুঁজির অভাবের কথা বলে বিদেশি কোম্পানির সাথে এরকম চুক্তি করা হচ্ছে। অথচ সর্বশেষ চুক্তি অনুযায়ী ওএনজিসি ৮ বছরে বিনিয়োগ করবে ১১০০ কোটি টাকা মানে বছরে গড়ে ১৩৮ কোটি টাকা। প্রতিবছর মন্ত্রী আমলাদের গাড়ি কেনার বা বিলাসিতার খরচ একটু কমালেই সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের টাকার যোগান হয়। ওএনজিসি ৮ বছরে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করবে তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে অলস পড়ে আছে। তারপরও পুঁজির অভাবের কথা বলে এমন মডেলে চুক্তি স্বাক্ষর করা হলো মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ যে শুধু বিদেশি কোম্পানির দখলে চলে যাচ্ছে তাই নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পায়নের জন্য গ্যাস সম্পদকে কাজে লাগানোর পথও রুদ্ধ হচ্ছে। আমদানি করা গ্যাসের চাইতেও বেশি খরচ হবে নিজ দেশের গ্যাস ক্রয়ে। উপরন্তু চুক্তির কারণে বাংলাদেশের আর্থিক বোঝাও সীমাহীন হবে।

প্রশ্ন করা হয়, এর বিকল্প কী? আমাদের তো গ্যাস লাগবে! বিকল্প নিশ্চয়ই আছে কিন্তু তাতে কমিশনভোগীদের সুবিধা নাই। আমরা সরকারকে এই ধরনের আত্নঘাতী চুক্তি স্বাক্ষরের পরিবর্তে জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে, প্রয়োজনে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে সাবকন্ট্রাক্টের মাধ্যমে, জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম গ্রহণের দাবি জানিয়েছি বারবার।

‘বাংলাদেশের সক্ষমতা নাই’ বারবার এই যুক্তি তুলে এসব চুক্তি করা হচ্ছে। কবে এই সক্ষমতা আসবে সেব্যাপারে কি কোন কথা আছে? জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে সরকারের কি কোন উদ্যোগ আছে? নেই। ভারতের সক্ষমতা অর্জনে কতো বছর লেগেছিলো? প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পর ওএনজিসি সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছিলো। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও ‘আমরা পারবো না’ এটাই সরকারগুলোর সার্বক্ষণিক কথা। অক্ষমতার যুক্তি তুলে, দেশের ভবিষ্যৎ উজাড় করে, জনগণের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেবার আয়োজন হয়। তার বদলে কমিশন কিংবা ক্ষমতার নিশ্চয়তা।

দক্ষ কোম্পানি বলে যে ওএনজিসির সাথে চুক্তি করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ ভারতেই আছে। অথচ দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণের ধারা দুর্বল করে রাখা হয়েছে। আর মাগুড়ছড়া টেংরাটিলার অভিজ্ঞতা তো আমাদের আছেই। কোন সরকার এই ক্ষতির জন্য মার্কিন ও কানাডিয়ান কোম্পানির কাছ থেকে আমাদের প্রাপ্য ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আদায়ের উদ্যোগ নেয়নি।

এই ধরনের পিএসসি প্রক্রিয়া, সরকার নির্বিশেষে, স্থলভাগ ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদ ক্ষমতার নিশ্চয়তা বা উচ্চ কমিশনের বিনিময়ে বিদেশিদের হাতে তুলে দেবার ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ। সরকার কোন যুক্তি শুনতে আগ্রহী নয়, দেশের বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। জনগণকে বঞ্চিত করে, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে দেশের সম্পদ উজাড় করে দেওয়ার এইসব আয়োজনের বিরুদ্ধে তাই দেশবাসীর সক্রিয় প্রতিরোধ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। স্বাধীন মানুষের বদলে কমিশনভোগীরা দেশ চালালে কী হয় তাই দেখছে বাংলাদেশ গত কয়েক দশক ধরে। অবস্থা এরকম থাকলে সর্বনাশা চুক্তি হতেই থাকবে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s