
বিশ্বকাপ, আমাদের খেলার মাঠ কিংবা ‘ঘাড়ে মাথা’ প্রসঙ্গ
–আনু মুহাম্মদ
বিশ্বকাপ ফুটবলের আনন্দ উত্তেজনার অংশীদার কমবেশি আমরা অনেকেই। কিন্তু যারা বাংলাদেশের খেলার মাঠগুলো খেয়ে ফেলে এদেশের শিশু কিশোর তরুনদের বর্তমান ভবিষ্যত্ চুরমার করেছে, তারাও কি এসব খেলা দেখে? তাদের কি সেই এখতিয়ার আছে? ঢাকা মহানগরীর বহু খেলার মাঠ এখন বিভিন্ন সরকারের আমলের ক্ষমতাবান ব্যক্তির মালিকানাধীন সুউচ্চ ভবনে আলোকিত। যাও দুএকটি আছে সেগুলোও প্রতিনিয়ত দখলের হুমকির মুখে।
ব্রাজিলে বিশ্বকাপ হচ্ছে, চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য ব্রাজিল দল খেলছে, এতে সেদেশের মানুষের চাইতে আনন্দ বেশি আর কার হতে পারে? কিন্তু বিশ্বকাপের উচ্ছাসের মুখে সেই দেশের মানুষ দুনিয়া ভুলে যান নি, নিজেদের অধিকারের মৌলিক প্রশ্ন তুলে রাস্তায় নেমেছেন। মানুষের জন্যই তো খেলা হবে, তাদের উচ্ছেদ করে তাদের শিক্ষা চিকিত্সা সংকোচন করে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে কীভাবে খেলা আনন্দময় হতে পারে? ব্রাজিলের মানুষের অবস্থা অবশ্য আমাদের চাইতে ভালো। তাদের খেলার মাঠ কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। তারপরও প্রতিবাদ ধর্মঘট আর পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে তারা প্রমাণ করেছেন উচ্ছ্বাস আর বিজ্ঞাপনের আলোকচ্ছটা দিয়ে তাদের ভোলানো যাবে না। তারা খেলা দেখছেন কিন্তু বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চারও থাকছেন। বিশ্বকাপ উদ্বোধনের চারদিন আগে উদ্বোধনের শহর সাও পাওলো ভরে গিয়েছিলো প্রতিবাদ, টিয়ারগ্যাস আগুনে। সাবওয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘটে শহর অচল হয়ে গিয়েছিলো। বাস ভাড়া বৃদ্ধির কয়েক মাস আগে কয়েক লক্ষ মানুষের বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। দেশের বিভিন্ন শহরে খনি, রেলওয়ে, টেলিফোন, কৃষি, স্বাস্থ্য শ্রমিক, আদিবাসী, ভূমিহীন মজুর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আর সেইসাথে একের পর এক ধর্মঘট জানান দিচ্ছিলো ব্রাজিলের মানুষ সজাগ ও সক্রিয়।
বিশ্বকাপ আয়োজনে ব্রাজিল ব্যয় করছে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ব্যয় টান দিয়েছে শিক্ষা চিকিত্সাসহ সর্বজনের বিভিন্ন খাতে। উপরন্তু বিশ্বকাপের জন্য নতুন স্টেডিয়াম, হোটেল পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। যে ব্রাজিল ফুটবলের প্রাণ সেখানেই শ্লোগান উঠেছে, ‘আমাদের কাপ দরকার নাই, আমাদের দরকার শিক্ষা চিকিত্সা বাসস্থান।’ বস্তুত এই দুই এর মধ্যে কোন সংঘাত অনিবার্য কেন হবে? একটি বাদ দিয়ে কেনো আরেকটি নিশ্চিত করতে হয়? করতে হয় তখনই যখন বাণিজ্যিক স্বার্থ কেন্দ্রে রাখতে গিয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার বিপন্ন করা হয়। আসলে দরকার দুটোই।
সেজন্য ট্রেড ইউনিয়ন, শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন পেশাজীবীদের সংগঠন, ফেসবুক ইত্যাদির মাধ্যমে শহরে শহরে যে জনপ্রতিবাদ গড়ে উঠেছে তা উন্নয়ন ধারা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। এটা ঠিক যে, বর্তমান ব্রাজিল দুই দশক আগের ব্রাজিল নয়। ৮০ দশক পর্যন্ত ব্রাজিল পরিচিত ছিলো ভয়ংকর স্বৈরশাসন, দারিদ্র আর ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর বিপুল ঐশ্বর্যের দেশ। ভয়ংকর নির্যাতনে প্রতিবাদী কন্ঠ স্তব্ধ করতে ব্রাজিলের সামরিক আধাসামরিক বাহিনীর সাথে সিআইএ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগী ভূমিকার অনেক কাহিনী এখন প্রকাশিত। এখনও ট্রুথ কমিশনে নির্যাতকদের সার্থ নেয়া হচ্ছে, শত হাজার মানুষকে নির্যাতন, আদিবাসীদের গণহত্যাসহ খুন ও গুমের অসংখ্য বীভত্স কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছে। ব্রাজিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই ভয়াবহ দশকগুলো পার হয়ে এসেছেন। পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়েই শ্রমিক নেতা লুলা প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
লুলা জনগণের সকল প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলেও জগদ্দল পাথর থেকে ব্রাজিলকে বের করেছিলেন। পরিবর্তনের অনেকগুলো জায়গায় হাতও দিয়েছিলেন। দারিদ্র কমেছে, উন্নয়ন ধারায় জনসম্পৃক্ততা বেড়েছে। তাঁকে আপোষও করতে হয়েছিলো পুরনো বিশেষত বৃহত্ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সাথে। তার ফলে জনগণের মৌলিক অধিকারের অনেককিছু অপূর্ণ রয়ে গেছে, ঝুঁকি থেকে গেছে। যথাসময়ে লুলা ক্ষমতা ছেড়েছেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এসেছেন লুলার সমর্থন নিয়েই। সামনের অক্টোবরে আবার নির্বাচন, কঠিন পরীক্ষা তাঁর। ব্রাজিলের প্রতিবাদী মানুষ অবশেষে খেলার জন্য কিছু বিরতি দিয়েছেন। কিন্তু যেভাবে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছে, যেভাবে সম্পদের স্থানানত্মর ঘটেছে, যেভাবে মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন, যেভাবে দারিদ্রের সুযোগে বিশ্বকাপের উত্সবে শিশু পতিতাবৃত্তির বিসত্মার ঘটেছে এগুলোর দায় সরকারের ওপরও পড়বে।
শুধু ফুটবলের ক্ষেত্রে নয় মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও অধিকারবোধেও যে ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে তা এই বিশ্বকাপ ঘিরে নানা তত্পরতা থেকেই আবারো স্পষ্ট হয়। আমাদের দেশে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে এতো উত্সাহ এতো উচ্ছ্বাস এতো পতাকাযুদ্ধের পাশাপাশি যদি অন্তত নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য খেলার মাঠ দখলমুক্ত করবার দাবি উচ্চারিত হতো – তাহলেও আমরাও বলতে পারতাম আমরা শুধু জোয়ারে ভাসি না, আমাদের নিজস্ব চলত্শক্তিও আছে। ফুটবল নিয়ে সব আনন্দ উত্তেজনার সাথে যদি সবার মধ্যে এই উপলব্ধি আসতো ‘আমাদের খেলার মাঠ নাই’, আমাদের শিশু কিশোর তরুণ ছেলেমেয়েরা জীবনের এক বড় আনন্দ অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাহলেও নিজেদের জীবন থেকে কারা কারা কী কী লুট করে নিচ্ছে তার প্রতি কিছু নজর আসতো।
এদেশে রাজনীতি খেলা ধর্মীয় নানা আয়োজন থেকে আমরা দেখি এদেশের লুটেরা দখলদার গোষ্ঠী বিজ্ঞাপনী উন্মাদনায় খুব সহজেই মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে ফেলতে পারে। তাই এখনও জোয়ারে ভাসতেই আনন্দ বেশি। খেলার মাঠের কী দরকার? টিভিতেই তো খেলা ভালো দেখা যায়৷ বড় বড় স্ক্রীণ লাগালে আরও সুন্দর লাগে। অনেক জায়গায় যারা খেলার মাঠ দখল করেছে-করছে সেই বড় ভাই বা বসরাই ফুটবল খেলা দেখার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। সবাই খুশি৷ কোন প্রশ্ন নাই। অসুবিধা কী? ভার্চুয়াল জগতে থাকলেই তো ভালো! পরিশ্রম নাই, ঝামেলা নাই!! এতো কিছু চিনত্মারও দরকার নাই৷ তাহলে সমগীতের একটা গান সবাই মিলে গাইলে হয়: ‘আমার কী আনন্দ ভাই, আমার ঘাড়ে মাথা নাই!’