শব্দের উৎস নিয়ে রাজনীতি জাতীয় ঐক্য ও স্বার্থের পরিপন্থী

শব্দের উৎস নিয়ে রাজনীতি জাতীয় ঐক্য ও স্বার্থের পরিপন্থী

 আহমেদ শামীম

“তারা “জয় বাংলা” বলে না, বলে “জিন্দাবাদ”। যেটা উর্দু শব্দ। বাংলা ভাষায় “জিন্দাবাদ” বলে কোনো শব্দ নেই। ভাষা আন্দোলনে আমরা উর্দুর বিরোধিতা করেছিলাম। এখনো তারা সেটাই ব্যবহার করে। যারা “জিন্দাবাদ” বলে, তারা বাঙালি নয়, পাকিস্তানের এজেন্ট। তারা দেশ থেকে চলে যায় না কেন? যারা এ দেশে থেকে “জিন্দাবাদ” বলে, তাদের পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত।” – সজীব ওয়াজেদ জয় (সূত্র: প্রথম আলো, ১২ জুলাই)।

সজীব ওয়াজেদ জয় নিশ্চয়ই জানেন বাংলাভাষীর মানস-অভিধানে “জিন্দাবাদ” শব্দটি বহালতবিয়তেই আছে, যেমন আছে “আওয়ামী” শব্দটি। উৎস ধরে ধরে বাংলাভাষা থেকে উর্দু শব্দ বাদ দিলে, নিজেদের দলের নাম আগে পরিবর্তনের দরকার হবে। উৎস নিয়ে আলোচনাও জয়ের জন্য কোনো বিজয় আনবে না, কারণ, জিন্দাবাদের আসল উৎস ফার্সি, সেখান থেকে হিন্দুস্তানী ভাষায় আসে (যেমন হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ)। উর্দু আর বাংলা ভাষা ওই শব্দটি হিন্দুস্তানী থেকে নিয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী শব্দটি আরবি রূপমূল নিয়ে তৈরি হয়েছে উর্দু ভাষাতেই। যাহোক, এসব কোনো কাজের কথা না, কথা হল- ভাষার বিষয়টা ভাষাভাষীর ওপরই ছেড়ে রাখা শ্রেয়। এটা মৌলিক শিক্ষা। এই শিক্ষা জনাব জয়ের আছে। কিন্তু তবু তিনি কেন এই বক্তব্য দিচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে রাজনীতির ক্ষেত্রে। যেখানে বিভেদ তৈরি করার মধ্যেই দলীয় রাজনীতির অস্তিত্ব নির্ভর করে, সেখানে নানারকম ফ্যাঁকড়া ফ্যাসাদ তৈরি করে দলগুলো তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে- এর আর গত্যন্তর কী! অন্য কথায় জয় যে তর্কটি তুলতে চাইছেন, তা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিকতায় এসকল তর্ক তুলে বহুবিধ রাজনতিক ফায়দা হাসিল করা যায় বলেই রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এমন বক্তব্য আমরা পাই। যেমন, দেশের মূল সমস্যাগুলো থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে ফেলতে একরকম অমূলক তর্ক তোলার পেছনে এসব বক্তব্যের একটা ভূমিকা আছে, সত্যি। তবে এ জাতীয় বক্তব্য অমূলক নয়। এদের মূল প্রোথিত আছে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটা অবিচ্ছেদ্য খামতির জমিতে, যেখানে বৈষম্যে উৎপাদন করে দলীয় স্বার্থ সহজেই হাসিল করা যায়। এ লেখায় সে বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাইছি।

সবাই আমরা জানি, রাষ্ট্রের চোখে তার সকল নাগরিক সমান। এখন, রাষ্ট্রতো আর নিজে চলে না, চালায় সরকার। আর, সরকারের দায়িত্ব নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকার পালন করা। তো, এ পর্যন্ত ঠিক আছে, কোনও পক্ষপাত নাই, বিদ্বেষের বিষয় নাই। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার আসে একটা রাজনৈতিক দল থেকে। কিংবা একটার নেতৃত্বে একাধিক দলের কোয়ালিশন থেকে। এখন আওয়ামী লীগ আর বিএনপি, বাংলাদেশের বড় দুইটি রাজনৈতিক দল, যে দলই ক্ষমতায় আসে, সরকার গঠন করে, নিজের দলের প্রতি, দলের লোকদের প্রতি স্বজনপ্রীতি করে, আর অন্যদের প্রতি বিদ্বেষী, বিধ্বংসী হয়ে ওঠে I তাই এই আওয়ামী বিএনপি দ্বারা রাষ্ট্রের যে বেসিক প্রতিশ্রুতি- সকল নাগরিকের অধিকার সমান – সেই সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব না। কারণ, ওই সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো (জাপা, জামাতসহ সমগরোত্রীয় দলগুলোকে হিসেবে ধরেই বলা) দাঁড়ায় এবং দাঁড়িয়ে থাকে দেশের জনগণকে বিভাজিত করে, জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। এই বিভেদ তৈরি করার ভেতর দিয়েই এই দলগুলো বেচে থাকে, এই বিভেদকে পুঁজি করে নির্বাচন করে, নির্বাচন জেতে- এটাই তাদের নিয়তি। বলতে গেলে, গোটা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থারও এটা নিয়তি। সিস্টেমের ভেতরকার এই খামতি বা বৈষম্য উৎপাদনের জন্য উর্বর এই জমিটুকুকে কীভাবে অনাবাদী রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় এটাই এখন আধুনিক বিশ্বে উদারনৈতিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পশ্চিমা দেশগুলো নানা রকম চেষ্টাচরিত্র করে। এর মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বকে বিকেন্দ্রীকরণ করা, ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে এমন আইন তৈরি করা, রাজনৈতিক ও সামাজিক মাইনরটিগুলোর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্যতম। এখন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সরিষা আপনি নিবেন, যে সরিষায় বৈষম্যের ভূত অলরেডি আছে, সেই ভূতকে বশে রাখার জন্য ওই গণতন্ত্রের বাকী ব্যবস্থাগুলো নিবেন না, তাহলে নিপীড়ণ কমাবেন কী করে? গোটা সিস্টেমকে ছুঁড়ে ফেলে সাম্যবাদী কোন সিস্টেম প্রতিষ্ঠাওতো আপনি করছেন না, তাহলে উপায়?

এই উপায় খোঁজার ব্যাপারে বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। বরং তারা উল্টা কাজ করে দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। তবু তারা কী করে প্রতিবার পাড় পেয়ে যাচ্ছে? বিদ্যমান গণতান্ত্রিক সিস্টেমের ওই খামতিটি ব্যবহার করে, বৈষম্যের ওই উর্বর জমিতে ব্যাপকহারে চাষবাস করে, বিষবৃক্ষ ফলিয়ে, সমাজকে শতবিভক্ত করে কমজোর করে দিয়ে, তারা পর্যায়ক্রমে দেশ শাসন করে আসছে। দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে সামাজিক ভেদ আছে, সব দেশেই আছে, কিন্তু সেই ভেদরেখা বরাবর রাজনৈতিক রেখা আরোপ করে একে ওপরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার যে রাজনীতি দেশে চলছে তাতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশে মুখ থুবড়ে আরও বহুকাল পড়ে থাকবে তা সহজেই বলে দেয়া যায়। উপরন্তু, সামাজিক ওই ক্যাটাগরিগুলোকে সাব ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সেগুলোর ভেতরকার বৈচিত্র্যকে বিভেদে পর্যবসিত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রয়াস চলছে। উদাহরণ যেমন আজকের এই লেখার উছিলাস্বরূপ জয়ের বক্তব্যটি। ভাষার মত একটা এজমালী সম্পত্তি থেকে এর শরিকদের কেবল শব্দের ব্যুৎপত্তি ধরে বিভাজনের এই বক্তব্যে ভাষাবিদ্যার সম্মতি নেই। কেননা ব্যুৎপত্তি যাই হোক বাংলা ভাষীদের মাতৃভাষায় ব্যবহার করা শব্দাবলী বাংলা ভাষারই সম্পদ। বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাণ্ডারকে ভেঙ্গে “জয়বাদী বাংলা” আর “জিন্দাবাদী বাংলা”র রাজনীতি করার অর্থ হল সমাজ-ভাষার ভাষার ভিত্তিতে রাজনৈতিক অপর তৈরি করা। তাছাড়া এই বিভেদ সৃষ্টির কল্পে ভাষা আন্দোলনকে ব্যবহার করাও অন্যায্য। কেননা বায়ান্ন উর্দু বিদ্বেষী কোন লড়াই ছিল না, ছিল রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ বিষয়ে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিপরিতে আরেকটি রাজনৈতিক দাবী আদায়ের সংগ্রাম। সেক্ষেত্রে কেবল দলীয় রাজনীতির সুবিধা আদায়ের জন্য শব্দের ব্যুৎপত্তি ধরে বাংলাভাষীদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা, এবং এর দোহাই হিসেবে ভাষা আন্দোলনকে অন্যায্যভাবে ব্যবহার করাটা জাতীয় ঐক্য নষ্টকারী এবং জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী রাজনীতি বৈ কিছু নয়।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s