আমাদের নানু সুষমা বালা চাকমা : এক শহীদের মা

Susama Bala Chakma

আমাদের নানু সুষমা বালা চাকমা : এক শহীদের মা 

By Samari Chakma, Originally published in ThotKata

আচ্ছা নানু তোমার বয়স এখন কত?
‘জানিনা। আমাদের জন্মের বছর তারিখ কি মা বাবারা লিখে রেখেছিল? তবে মনে হয় আমার বয়স হবে এখন আশি বা তার বেশী।’


কাপ্তাই বাধের পূর্ববর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের রাংগামাটি জেলার লংগদুর একটা গ্রাম হাক্কন চন্দ্র পাড়া। হাক্কন চন্দ্র গ্রামের অধিবাসী ধলচান চাকমা। এই ধলাচান চাকমার দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম হরিশচন্দ্র চাকমা ওরফে চেলা মাষ্টার আর ছোট ছেলের নাম কল্পতরু চাকমা। চাকমাদের অনেক গোজার মধ্যে বড় হাম্বে গোজা একটি। এই পরিবার বড় হাম্বে গোজার উত্তরসূরী। হরিশচন্দ্র চাকমা ওরফে চেলা মাষ্টার সেসময়ে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আর কল্পতরু চাকমা ছিলেন হাতীর দাঁতের একজন কারুশিল্পী। পরবর্তীতে যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মোদের মধ্যে প্রথম কারুশিল্পি হিসেবে স্বীকৃত ও সম্বানিত হয়েছেন। এই পরিবারের বড় ছেলে হরিশচন্দ্র চাকমা আর আলিয়া চাকমার মেয়ে সুষমা চাকমা। সুষমার চাকমার জন্ম কত সালে কোন মাসে কোন তারিখে সেটা বলা এখন কঠিন। তবে তিনি মনে করেন তাঁর বয়স এখন ৮০ বছরের উপরে। তিন ভাই তিন বোনের স্বচ্ছল সংসার ছিল সুষমা চাকমার পরিবারের। বাবা ছিলেন শিক্ষক তাই এলাকার লোকজন তাদের খুবই সন্মান করতো। স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম আর বড় হবার কারণে জীবনের প্রথম ভাগে অভাব অনটন দুর্দশা অশান্তির সাথে তাঁর পরিচয় হয়নি। এই সুষমা বালা চাকমা হচ্ছেন আমার মায়ের মা। আমার নানু। নানুর পুরো নাম হচ্ছে সুষমা বালা চাকমা। তবে নানু সবসময় বলে ওর নাম সুষমা চাকমা। আমরা তাঁর মেয়ের ঘরে নাতনিরা এই নিয়ে সুযোগ পেলেই খোঁচায়। বলি, না না না, নানু তোমার নামতো সুষমা বালা চাকমা। কিন্তু ‘বালা’ শব্দটা নানুর বড়ই অপছন্দ। তাই নাম থেকে বালা শব্দ বাদ। শুধু সুষমা। সুষমা চাকমা।
সুষমা চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে আলোচিত সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী , যে সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল কাপ্তাই বাধের কারনে পানিতে তলিয়ে গেছে চিরতরে, সংগে তলিয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ একর ফসলি উর্বর, টিলা পাহাড়ি জমি। ফলে লক্ষ লক্ষ চাকমা ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন সংগে কিছু হাজং, মার্মা আর কিছু পুরাতন বাঙালী অধিবাসীরাও তাদের সবকিছু হারিয়েছেন। সবচেয়ে অবস্থাপন্ন পরিবারও উদ্ভাস্তুতে পরিণত হয়েছেন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে হয়েছে চিরদিনের জন্য। শুধু তাই নয় অর্ধলক্ষাধিক চাকমা, হাজং এবং কিছু ত্রিপুরা অধিবাসীকে চিরতরে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, যেতে হয়েছিল ভারতে। তিনি কাপ্তাই বাধের নির্মাণ দেখেছেন আর এর ফলে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন একেবারে সামনে থেকে, একই সংগে নিজেই হারিয়েছিলেন জন্মভূমি, নিশ্চিন্ত সুখের জীবন, স্বামীর সরকারী চাকুরী, অতি চেনা আত্মীয় স্বজন আর মুখোমুখি হতে হয়েছে অভাব অনটনের, বেছে নিতে হয়েছে শরনার্থীর মত জীবন সংগে সম্বল ছিল শুধুমাত্র হাজারো পুরোনো স্মৃতি আর যেকোন ভাবে বেঁেচ থাকতেই হবে এই মনোবল। পুরাতন জায়গা ছেড়ে আসার পর নতুন জায়গায় বছরের পর বছর নিঘুর্ম কাটিয়েছেন বাঘ আর সাপ এর ভয়ে। পাঁচ ছেলে দুই মেয়ের মা হয়ে সংসারের হাল ধরেছেন তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছেন। লড়াইএর এই পর্যায়ের কঠিন সংগ্রামে যখন জিতে গেলেন তখন তাঁর মাঝ বয়স। কিন্তু এই বয়সে এসেও সুখ ধরা দেয়নি তাঁর কাছে। এবার অন্য রকম লড়াই। তাঁর এক ছেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মোদের স্বাধিকার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং আর্মির গুলিতে নিহত হয়ে আন্দোলনের ময়দানে শহীদ হন। এই ছেলে হারানোর শোক একাকী নিজে নিজে লড়াই করেছেন সারাটা জীবন। এটি এমন এক কষ্ট যা অন্য কারোর সাথে ভাগ করা যায়না। তাছাড়া নিজের আর পরিবারের বাকী সদস্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজের ছেলের মৃত্যুর কথা কাউকে বলতে পারেননি দীর্ঘসময়। নিজের কত না বলা দু:সহ স্মৃতিকে সাথে নিয়ে আজ তিনি জীবন সায়াহেৃ।

কাপ্তাই বাধ বানানো শুরু হবার বেশ আগে এক আষাঢ় মাসে সুষমা চাকমার বিয়ে হয়। পুরাতন রাংগামাটি শহরে কাছের গ্রাম বড়াদাম, সেই গ্রামের ছেলে ত্রৈলক্য চন্দ্র চাকমার সাথে। তাঁর শশুর বাড়ির লোকেরা ধামেই হোজার মুত্তি গোষ্ঠীর বংশধর। ত্রৈলক্য চন্দ্র চাকমা ছিলেন পুলিশের দারোগা। তখনকার সময়ে জুম্মোদের মধ্যে সরকারী চাকুরীজীবি খুব কম ছিলেন। এজন্য মনে হয় প্রায় তিনি খুব গর্ব করে বলেন ‘তোমার দাদুর চাকুরীর কারণে আমি অনেক জায়গা যেতে পেরেছি। প্রথমে মালছড়ি মানে মহালছড়ি, তারপর রামগড় এবং পানছড়িতে যেতে পেরেছিলাম। তখনতো এখনকার মতো রাস্তা ঘাট ছিলনা। আসা যাওয়া করতে হতো হেটে বা নৌকায়। একেকটা জায়গায় গেলে অনেক দিন লেগে যেতো। আমরা একেক জায়গা থেকে থেমে থেমে আরেক জায়গা যেতাম। তবে চুরি ডাকাতির বা এইসময়ের বাঙালীদের ভয় ছিলনা। মানুষজন কম থাকলেও ভয় ধর ছিলনা সেসময়।’
– নানু তোমার ডুবে যাওয়া শশুর বাড়ি দেখতে কেমন ছিল? তখনকার জীবন কেমন ছিল?
– ‘ ঘরদোর দেখতে খুব সুন্দর ছিল। অনেক বড় না হলেও দেখতে সুন্দর ছিল। গুদাম ঘর। তবে বিশাল রান্না ঘর ছিল আর ছিল লম্বা পাকা সিড়ি। আমার যে বাড়ীতে বিয়ে হয় সে বাড়ির লোকজন হয়তো জমিদারদের মতন ধনী ছিলনা, কিন্তু গিরিত্তি মানে অবস্থাপূর্ন পরিবার বলতে যা বুঝায় তাই ছিল। তোমার আজুরা ছিল তিন ভাই দুই বোন। জীবন সহজ সরল সুখের আনন্দর্পূণ ছিল। তখন কোন চুরি ডাকাতি ছিলনা। যদিও গ্রামের বাড়ি ঘর এক একটা থেকে একটু দূরে দূরে তারপরও আরামে থাকতে পারতাম আমরা। ভয়ের কিছু ছিলনা। অবশ্য চাকুরীর কারণে আমি অনেকটা সময় গ্রামের বাইরে ছিলাম।’
কিন্তু সুষমা চাকমার সেই সুন্দর ঘর নিয়ে বেশীদিন আনন্দের সংসার করা হয়নি। বিয়ের কয়েকবছর পর কাপ্তাই এলাকায় কর্ণফুলির নদীর উপর বাধ বানানো শুরু হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। আজো এই বয়সে সেই সব স্মৃতি জ্বল জ্বল করে তাঁর মনে।
-আচ্ছা তুমি কি কাপ্তাই বাধ বানানো দেখতে গিয়েছিলে?
-‘হ্যাঁ। দুবার দেখতে গিয়েছিলাম। একবার বানানোর সময় আরেকবার বানানো শেষ হবার পর। প্রথমবার দেখতে গিয়ে হা হয়ে ছিলাম। কত্ত বড় বড় গর্ত। না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। আর কত বড় বড় মেশিন।
কত লোক কাজ করছে। আর শুধু মেশিনের শব্দ। অনেক দূর থেকে সেই শব্দ শোনা যায়। আমার আরেকবার কাপ্তাই বাধ দেখতে ইচ্ছে করে খুব। তবে আর হয়তো দেখা হবেনা। (দীর্ঘশ্বাস) ’
– তোমরা কি জানতে এই বাধের পানিতে তোমাদের সবকিছু ডুবে যাবে ?
– জানতাম। সবাইকে জানানো হয়েছিল। গ্রামে গ্রামে বলে দিয়েছিল জায়গা জমি সব ডুবে যাবে আর কে কোথায় গিয়ে জায়গা নিতে চাই সেসব তালিকায় নাম লিখতে। আমরা জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম মারিশ্যা কাজালং এর এলাকা। এরপরেই তো আমরা কাজালং চলে আসি।
তবে পুরোনো বড়াদাম পানিতে তলিয়ে যাবার আগে নানু আজু আর তাদের দুই সন্তান নিয়ে কিছুদিনের জন্য চলে যান বাবার বাড়ি হাক্কন চন্দ্র গ্রামে। এই গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত নানু এখানেই ছিলেন। পানি আসার পরও নানু আর আজু চলে যান নতুন জায়গায় বাবা আর ভাইদের সাথে দুরছড়ি তে। বেশ কিছু সময় এখানেই ছিলেন নানু ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাবা আর ভাইদের সাথে। আজু তখন নতুন জায়গায় চলে গেছেন জায়গা দখলে নিতে ।
-তাহলে কি আজু আর চাকুরীতে ফিরে যাননি? আজুকে চাকুরী ছাড়তে হয়েছিল কাপ্তাই বাধের কারণে ?
-‘ হ্যাঁ। তোমাদের আজু আর চাকুরীতে ফিরে যাননি। কাপ্তাই বাধের ফলে আমাদের সবকিছু তো ডুবে যাবে। নতুন জায়গায় যেতে হবে। সেখানে গিয়ে জায়গা দখল নিয়ে নিজের দখলে আনতে হবে। বাসযোগ্য করতে হবে। তাছাড়া মানুষ গুনেই তখন জায়গা বরাদ্ধ দিচ্ছিল সরকার। ক্ষতিপূরণের পরিমান ছিল অনেক কম। হঠাৎ করে জায়গা হারা হয়ে গেছি সবাই। চাকুরীতে থাকলে ভালো জায়গা পাবোনা কম জায়গা ভাগ পাবো তাই তোমার আজু চাকুরী ছেড়েছিলেন। কিন্তু কি জানো, এতকিছুর পরও আমরা ভালো জায়গা পাইনি। খুব কম জায়গা পেয়েছি। শুধু এই জায়গাটা পেয়েছিলাম। কারণ হাজার হাজার মানুষের জন্য বসবাস করার মত জায়গা খুব কম ছিল। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেকেই আরো ভালো জায়গা আর বেশী জায়গা পাবার আশায় অন্যত্র চলে গিয়েছিল। প্রথম দিকে আমরা ছিলাম কাজালং নদীর চরে ছোট্ট ছোট্ট চার বেড়ার লম্বা ঘর করে অনেক বছর অনেক পরিবার একসংগে মিলে। এইযে এই ভিটেটাতে, এখন আমরা যেখানে বাড়ী করেছি এখানে সেসময় জুম করতাম। কিন্তু বর্ষার পানিতে কাজালং চর ডুবে যেতো তাই বাধ্য হয়ে এই ভিটায় এসে ঘর করেছি। তবে আমার আজো মনে আছে তখন পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই বাধে ডুবে যাবে এমন এলাকার লোকদের নতুন জায়গায় যাবার জন্য বড় বড় নৌকা ভাড়া করে দিয়েছিল। এক একটা নৌকায় ৩/৪ টি পরিবার একসংগে। গ্রাম ছেড়ে নৌকায় করে আসার সেই স্মৃতি গুলো আজো জ্বল জ্বল করে মনে।
নৌকায় আমরা, সংগে তোমার ছোট্ট মা আর মামু, পুরোনো বাড়ীর কিছু জিনিষপত্র, সংগে আরো দুই/ তিন পরিবার। আস্তে আস্তে পানি উপরে যাচ্ছে আমরাও উজানে যাচ্ছি। বাধের কারণে নদীর পানিও বাড়ছে পানি আস্তে আস্তে উপরে দিকে উঠছে আমাদের নৌকা সেই পানির উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একসংগে অনেক নৌকা, আমরা চলছি নতুন জায়গায় নতুন দিনের সন্ধানে। সেই এক দেখার মত। রাতের বেলায় দেখা যেতো শুধু লাইন ধরে অনেক মিটিমিটি আলো এগিয়ে চলছে। রাতেতো নৌকা দেখা যায়না শুধু ল্যাম্পের আলো ছাড়া। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। চারিদিকে ঘন জংগল। মাঝে মাঝে নদীর পাড় ঘেষে কিছু ঘর বাধা। সেখানেও কিছু মিট মিট আলো । যারা যাবে তাদের জিরোবার ঘর। সেই স্মৃতি কি ভুলা যায়? তো মারিশ্যায় আমরা যখন পৌঁছালাম দেখলাম শুধু জংগল আর জংগল। বাঘ সাপ চারিদিকে। বাঘের গর্জন এখনো কানে লেগে আছে। মনে হতো বাঘটা একেবারে বাড়ির উঠোনে। আমিতো বাঘের ভয়ে রাতে ঘুমুতে পারতামনা।’
প্রথম প্রথম নতুন জায়গায় এসে নানুদের অবর্নণীয় কষ্ট করতে হয়েছে। যে জায়গায় ওরা এসেছিল সেটা ছিল এক ঘন অরণ্য। কি নেই সেখানে। বাঘ থেকে শুরু করে সব ধরণের বণ্য প্রাণী । শুধু ছিলনা বাস আর চাষ যোগ্য জমি। তাই এসেই আজুদেরকে চাষবাষ আর বসবাসের জন্য জমি তৈরী করতে ঘন জংগল কেটে সাফ করতে হয়েছিল বছরের পর বছর। তখন কিন্তু বাসযোগ্য জমি তৈরী করা এত সহজ ছিলনা যত সহজে এখন আমরা বলছি। ঘন অরণ্য, বিশাল বিশাল গাছ, শাপদ শংকুলে ভরা জংগল কলেরা টাইফয়েড এর মত অসুখ বিসুখ সহ সব প্রতিকূলতাকে জয় করে বেঁচে থাকা এত সহজ ছিলনা তাদের। কতজন যে মারা গেছে রোগে ভুগে। বিশেষ করে শিশুরা আর বৃদ্ধরা। সে হিসেব কেউ রাখেনি।
এইভাবে নতুন জায়গায় সম্পূর্ণ জংগলের ভিতর নতুন গ্রামের পত্তন হলো। নাম দেয়া হলো পুরোনো গ্রাামের নামে ‘বড়াদাম আদাম’ কিন্তু পুরোনো গ্রামের লোকজন এই গ্রামে থিতু হলো খুব কম সংখ্যায়। সবাই অন্য আরো ভালো জায়গার খোঁজে চলে গেল এদিক সেদিক। আত্মীয় স্বজন পরিজন সবাই সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলো নতুন ভালো জায়গার আশায়। অনেকে চলে গেলো ভারতে ‘নেফায়’। চাকমাদের কাছে এই চলে যাওয়ার নাম হলো ‘বড়পুরং’।
-তোমার বাবাদের খবর কি হলো ? ভাইদের ?
-‘বাবাতো অনেক আগে মারা গিয়েছে। আমাদের সেই গ্রামও ডুবে গেছে। আমার বাবার পরিবারের বাকিরা দুরছড়িতে চলে গেল সেখানেই থিতু হলো।’
তো এই নতুন বড়দাম গ্রামে সুষমা চাকমা পাঁচ ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে নতুন করে সংসার শুরু করলেন। থিতু হলেন। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হতে লাগলো। আজু এখানে মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হলেন বেশ কবার। সবাই ত্রৈলক্য চন্দ্র মেম্বার বললেই একনামে চিনে। তাদের বাড়ীতে একবার চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় বেড়াতে এসেছিলেন। এইটা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার বেশ আগে। রাজার এই আসার কিছুদিন পর নানুদের বাড়ী আগুনে পুড়ে যায়। কিভাবে আগুন লাগলো সেটা তারা জানেনা। তবে নানুরা ভাবেন রাজা আসার কারণে পুড়ে গেছে। চাকমাদের কাছে একটা মিথ্ আছে এই ব্যাপারে কারোর বাড়ীতে যদি রাজা বা রাজ বাড়ীর কেউ পা দেয় তাহলে সংগে সংগে বাড়ী এবং বাড়ীর লোকজনকে সাফ সতুরা হতে হবে বা ‘মাথা ধুতে হবে’। কিন্তু নানুরা তা করেনি। সেজন্য ওরা ধরেই নিয়েছিল রাজার কারণে তাদের এই ঘর পুড়ে যাওয়া।
এভাবেই নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে সুষমা চাকমার সংসার স্থিতি পেল কাজালং বড়াদামে। একটু সুখ আর স্বচ্ছলতা নিয়ে সংসার চলছে। ছেলে মেয়েরা পড়া লেখা শিখে যার যার জায়গায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য চেষ্ঠা করে যাচ্ছে। ঠিক এই সময়ে তাঁর এই সুখের সংসারে আবার অশান্তি এসে হাজির হলো। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন তুংগে। পরিস্থিতি খুব খারাপ। বাংলাদেশ আর্মি পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রাসের রাজত্ব শুরু করেছে। আর্মি যখন তখন যাকে তাকে যেখান সেখান থেকে শান্তিবাহিনী মনে করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর গ্রামে গ্রামে প্রতিদিন শান্তিবাহিনী খোঁজে চালাচ্ছে অপারেশন। তাদের টার্গেট হচ্ছে ছেলে যুবক ছাত্র। এমনকি সরকারী চাকুরীজীবিদেরও আর্মিদের হাত থেকে রক্ষা পাবার কোন উপায় ছিলনা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জুম্মো মানেই সে শান্তিবাহিনীর সদস্য। কারোর উপর যদি একবার সন্দেহ হয় তাহলে তার আর রক্ষা নেই। আর একবার আর্মির হাতে ধরা পড়া মানে মহাবিপদ। সারা জীবনের জন্য পঙ্গু। তাই খুব বিপদে না পড়লে কেউ বাড়ী বা এলাকা ছাড়া হয়না। শান্তিবাহিনী নেতারা ছাত্র যুবকদের আহবান জানাচ্ছে সরাসরি লড়াইএ যোগ দিতে। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সৈনিক হতে। ঠিক এমন এক মুহুর্তে জনসংহতি সমিতির আহ্বানে আমার মেজ মামা একদিন শান্তিবাহিনীতে যোগ দিলেন। আমার এই মেজ মামা হচ্ছে সুষমা চাকমার পাঁচ ছেলের এক ছেলে নাম ‘ভিত্তি’। আমি তখন ছোট, মামুকে খুব আবছা মনে পড়ে। তবে এই মামু আমার ভীষণ প্রিয় ছিলেন। নানুদের বাড়ি মারিশ্যা, খাগড়াছড়ি থেকে অনেক দূরে হওয়াতে নানু বাড়ী আমাদের যাওয়া হতোনা বললেই চলে। তাছাড়া তখন গাড়ীর রাস্তাঘাট ছিলনা। হেটে যেতে হতো। প্রথমে দিঘীনালায় গিয়ে একরাত থেকে তারপরদিন ভোর বেলা হাটা পথে বেরোতে হতো। কয়টা মোন মানে বড় বড় পাহাড় পার হতে হতো জানেন ? অনেকগুলো। বার হাপ্যে মোন, ষোল হাপ্যে মোন, আদার হাপ্যে মোন তারপর ছড়া সমতল পথ জংগল গ্রাম পেরিয়েই তবেইতো নানুর বাড়ি- বড়াদাম। এখান থেকে ওখানে যাওয়া মোটেই নিরাপদ ছিলনা। আমার মনে আছে আমার প্রথম নানু বাড়ীতে যাওয়া হয়েছিল যখন আমি ক্লাশ ফাইভে পড়ি। এবং আমার সেই প্রথম শান্তিবাহিনীর সাথে দেখা। খাগড়াছড়ি থেকে আমরা প্রথমে দিঘীনালায় গেলাম। সেখানে রাতে কয়েকজনের সাথে দেখা হলো, মা চিনত তাদের। তারাও নাকি মারিশ্যা যাবে। তো তাদের সাথে করে আমরা এতবড় বড় মোন পার হয়েছিলাম। পরে জেনেছি এরাই নাকি শান্তিবাহিনীর সদস্য। শুধু দূরের পথের জন্য না, আমার মনে হয় নিরাপত্তার কারণেও আমাদের ভাইবোনদের নানুর বাড়ি বেড়ানো হয়নি তখন। অবশ্য বাবার চাকুরীর কারণে আমার বড় ভাই বোনের জন্ম হয়েছিল মারিশ্যায় বড়াদাম গ্রামে নানুদের বাড়ীতে। কিন্তু পরে বাবামা খাগড়াছড়ি চলে আসেন। নানুর বাড়ি আর আমাদের বাড়ির সেতু ছিলেন আমার এই ভিত্তি মামু। মামু বলতেই আমি তাকে চিনতাম। শেষ কবে তার সংগে দেখা হয়েছে সেটা আমার আর মনে পড়েনা। তো আমার এই মামু হারিয়ে গেলেন একদিন আমাদের মাঝ থেকে।
একদিন দেখি মা আর বাবা ফিসফিস করছে, ভিত্তি মামু শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। আর একদিন জানলাম মামুর আরেকটা নাম ‘জুনান’ মানে পূর্ণিমার চাঁদ, শান্তিবাহিনীতে যোগ দেবার পর এই নতুন নামকরণ তার। স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে যোগ দেবার পর আর কখনও আমাদের মামুর সাথে দেখা হয়নি। তবে অনেক দিন পর পর মামু লোক মারপত খবর পাঠাতেন তিনি ভালো আছেন। অমুক এলাকায় আছেন। এভাবে সময় চলে যায়। শেষ দিকে ভিত্তি মামু রাংগামাটির কাছে কোন একটা এলাকায় বদলী হলেন। সেটা ঠিক কোথায় আমরা জানতাম না। আমার দিদি নানুদের দিকের বড় নাতনি। তার কদরই আলাদা। তাই ভিত্তি মামু শুধু দিদিকে মাঝে মাঝে দেখতে চাইতেন লোক মারফত। কিন্তু মা আর বাবা লোক জানাজানি এবং আর্মিরা যদি জেনে যায় এই ভয়ে দিদিকে কখনও মামুর সাথে দেখা করতে পাঠাননি। শেষবার তিনি খবর পাঠালেন দিদিকে যেতে। দিদিকে একবার দেখতে চান। মা বাবা আর্মিদের ভয়ে না করে দিলেন। দিদি তখন কলেজে পড়ে। এটা কি ১৯৯০ বা ৮৯ এর দিকে? এই শেষবার মামুর সাথে অন্যের মারফত যোগাযোগ। হঠাৎ একদিন মা বাবা আবার ফিস ফিস করে আমাদের জানালেন যে মামু মারা গেছেন আর্মিদের গুলিতে। সাথে অনেক সহযোদ্ধা এমনকি যে বাড়ীতে মামুরা ছিলেন সেই বাড়ীর মালিকও মারা গেছেন। তিনি একজন নারী। কিন্তু ঠিক কখন কোন জায়গায় তিনি নিহত হয়েছেন সেটা আমরা কেউ জানিনা। সেই ঘটনার অনেক অনেক বছর পর্যন্ত আমরা কারোর কাছে বলতে পারিনি, বলা বারণ ছিল নিরাপত্তার কারণে আর্মিদের ভয়ে যে আমাদের মেঝ মামু স্বাধিকারের জন্য শহীদ হয়েছেন। তবে আমার মামু আমার মনে সবসময় ঘুরঘুর করতো। মনে মনে অনেক প্রশ্ন আসতো যেতো। মামু যে জায়গায় নিহত হয়েছেন সেই জায়গাটা দেখতে কিরকম খুব মন চাইতো। সেই পর্যন্ত। এভাবে অনেক বছর কেটে যায়। অনেক বছর পরে আমার জীবনে একটা কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। আমার নিজের সাংগঠনিক কাজে একেবারে কাকতালীয় ভাবে আমি রাংগামাটির সেই জায়গায় গিয়েছিলাম এবং লোকে মুখে আমি আমার মামুর শহীদ হবার সময়ের কাহিনী আর তার লাশকে কিভাবে আর্মিরা নিয়ে গিয়েছিল সেই কাহিনী শুনেছিলাম। আমার জীবনে এটি একটি অদ্ভুত ঘটনা। কিন্তু সেই কাহিনী অন্য আরেকদিন।
মামু মারা যাবার পর আমরা নানুর সামনে এই মামুর কথা কখনও বলতাম না। হয়তো নিজেরা নিজেরা বলাবলি করতাম। এখন নানুর বয়স আশি (৮০) বা তারচেয়ে বেশী এই সেদিন আমি নানুর সাথে গল্প করার সময় জানতে চাইলাম ভিত্তি মামুর কথা, জানতে চাইলাম তার লাশ ফেরত পেয়েছিল কিনা? মামুর সাথে নানুর শেষ কবে কথা হয়েছিল? এরকম অনেক অনেক প্রশ্ন।
‘ ২০ বছরের মতো হলো ভিত্তি মারা গেছে। তার মৃত্যুর খবর আমি জেনেছি সে মারা যাবার অনেক পরে, শুনেছি তার লাশকে আর্মিরা রাংগামাটি নিয়ে গেছে। কিন্তু আমি তার লাশ হাতে পাইনি। চোখেও দেখিনি। আর্মিরা লাশ ফেরত দেয়নি। কি করেছিল তাও জানিনা। মাটিতে চাপা দিয়েছে না আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছে সেসব আমরা কিছুই জানিনা আজো। তবে ভিত্তি যখন মারা যায় আমিও তখন রাংগামাটিতে। আমার ছেলেদের কাছে। একদিন একজন এসে বললো শান্তিবাহিনীর একজন নেতা মারা গেছে আর্মিদের গুলিতে রাংগামাটি এলাকায়। সাথে আরো কয়েকজন। মানুষের মুখেই শুনলাম সে মারিশ্যার বাসিন্দা। কিন্তু আমি ও আমার পরিবারের কেউ বুঝতেই পারিনি সে আমারই ছেলে ভিত্তি। কারণ তখন শান্তিবাহিনীতে অনেক মারিশ্যার ছেলে কাজ করতো। তাই এই ঘটনা শোনার পরও নিজের ছেলের কথা আমার মনেই আসেনি। মনে হয়েছিল হয়তো অন্য কারোর ছেলে। এই ঘটনার কিছুদিন পর আমি মারিশ্যায় চলে আসি। তখনও পর্যন্ত আমরা কেউই জানিনা ভিত্তি আর পৃথিবীতে নেই। তো বাড়ীতে এসেই আমি তার একটা চিঠি পাই। আমার ছেলে ভিত্তির লেখা। এই চিঠিটা সে মৃত্যুর আগে লিখেছিল এবং আমাকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু আমি রাংগামাটিতে অবস্থান করার কারণে চিঠিটা ঠিক সময়ে পাইনি। রাংগামাটি থেকে বাড়ীতে মানে মারিশ্যায় ফেরার পর চিঠিটা হাতে পাই এবং সেটা তার মৃত্যুর পরে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত আমরা কেউ জানতাম না সে আর বেঁেচ নেই। এটাই যে তার শেষ চিঠি। তার চিঠি মত আমি তার জন্য অপেক্ষা করি। দিন যায় রাত যায়, মাস চলে যায়। তার আর খবর আসেনা। তারপর একদিন তোমার ছোট মামু খাগড়াছড়ি থেকে বাড়ীতে আসে। তার কাছ থেকেই প্রথম আমরা সব জানলাম। ভিত্তি মারা গেছে। আর্মির গুলিতে নিহত হয়েছে। শুনলাম ভিত্তি যে বাড়ীতে ছিল সে বাড়ীর উপর হামলা করে আর্মিরা। বাড়ীর মালিক ছিলেন একজন বিধবা চাকমা নারী। সেও আমির্র এই হামলায় মারা যায়। ঘটনাটা ঘটেছে রাংগামাটির সাপছড়ি এলাকার একটা পাহাড়ের গ্রামে। আমার ছেলে ঐসময় অসুস্থ ছিল। তো অসুস্থ অবস্থায় ঐ বাড়ীতে সে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এই অবস্থায় সে মারা যায়। আর এই খবরের সাথে সাথে তার জন্য আমার অপেক্ষার পালাও শেষ হয় এভাবে। আমার ভাবতে খুব অবাক লাগে তার লেখা চিঠি পেয়েছি সে মারা যাবার পর। আর আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকতাম আমাকে সে নিতে লোক পাঠাবে। আমি দেখতে যাবো তাকে।
– ভিত্তি মামু তার শেষ চিঠিতে কি লিখেছিল নানু?
– ‘ অনেক কিছু লিখেছিল। তবে আমার এই কটা লাইন স্পষ্ট মনে আছে। লিখেছিল- মা, তুমি এখন এসোনা। আমি এখনো কোন জায়গায় ‘থিদ ’ হতে পারিনি। যদি একটা জায়গায় ‘থিদ’ হতে পারি তাহলে তোমাকে আমি খবর দিব। তখন এসো। লোক পাঠাবো, সেই তোমাকে আনতে যাবে।’
নোট : এইখানে একটা কথা বলা জরুরী আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল ধনসম্পদে আর শান্তিতে ভরপুর এক পাহাড়ী অধ্যুষিত এলাকা। এই এলাকার ভূমি ছিল উর্বর। গ্রামের সকলে নিজস্ব জায়গা জমি নিয়ে স্বচ্ছল আর শান্তির্পূণ ভাবে জীবন কাটাতো। কাউকে কারোর কাছে কখনও হাত পাততে হতোনা। পার্বত্য চট্টগ্রামে তখন বাঙালীদের বসতি ছিল শূণ্যের কৌঠায়। তবে সকল জুম্মো পরিবারে ধান্য জমি আর চাষাবাদের কাজ করতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসতেন বছরের একটা সময় সমতলের বাঙালীরা। তাই বাঙালীরা ছিলেন কামলা নামে এক অতিথি যারা শুধু কাজের জন্য পাহাড়ে আসা যাওয়া করতো আর কাজ শেষ হলেও চলে যেতো নিজেদের এলাকায় পরিবার পরিজনের ওখানে। যদিও পাহাড়ের চিত্র এখন ভিন্ন। বর্তমানে জুম্মো অধ্যুষিত এলাকা দিনকে দিন পরিণত হচ্ছে বাঙালী অধ্যুষিত এলাকায়। এখন পাহাড়ের এমন এলাকা দেখা যায় যেখানে বাঙালী আছে জুম্মোর অস্তিত্ব নেই। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফলে রাষ্ট্রের অসহযোগীতার কারনে জুম্মোরা নিজেদের বসতি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s