
যে ছেলে মেয়েটা মেধার লড়াই লড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ ছিনিয়ে নিচ্ছে তার জন্য আসলে কোন আলাদা পরিসর রাষ্ট্র দিচ্ছে কিনা৷ নাকি বিশ্ববিদ্যালয় কেবলই হরে দরে সার্টিফিকেট?
[Warning: Graphic Violence]
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার একবছর: বিচারহীনতার সংস্কৃতির অ-শিক্ষা
by Udisa Islam
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সান্ধ্যকালীন কোর্সের শুরু নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেছিলো। তাদের মনে হয়েছিলো, সান্ধ্যকালীন কোর্স শুরু হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হবেন। সন্ধ্যার শিক্ষার্থীদের সাথে বিরোধের বিষয় নয়। বিষয় হলো, সন্ধ্যার কোর্স নিয়ে যে শিক্ষকরা অনেক বেশি তাড়িত বোধ করবেন বছরের পর বছর তারা হয়তো দিনের কোর্সগুলো নিয়ে ভাবেন না ঠিকমতো। যুক্তি ন্যয়সঙ্গত।
তাদের আন্দোলনকে ঘিরে নানা পাল্টা যুক্তিও অনেকে হাজির করেছেন। মোটা দাগে সেগুলো হলো:
—– তাহলে কি কেউ পড়ার সুযোগ পাবে কেউ পাবে না এমন চায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা?
—– সান্দ্যকালীন কোর্সে টাকার বড় অংক সম্পৃক্ত থাকা না থাকায় কি আসে যায়? শিক্ষকরা কি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয় না?
—– সন্ধ্যার শিক্ষার্থীদেও টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে রোজগারতো দিনের শিক্ষার্থীদেরও কাজে লাগবে। তাহলে কেন বিরোধিতা?
বিরোধিতা নানা কারণেই তারা করেছেন। পাল্টা যুক্তিদাতারা বাণিজ্যিক শব্দটাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যার কোর্সেও বিরোধী না বাণিজ্যিক যে নাইট কোর্স সেটার বিরোধী। তাদের প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ জন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হারে টাকা দিয়ে ১০জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে টাকা দিয়ে পড়লে একই মনোযোগ পাবে তো?
যে ছেলে মেয়েটা মেধার লড়াই লড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ ছিনিয়ে নিচ্ছে তার জন্য আসলে কোন আলাদা পরিসর রাষ্ট্র দিচ্ছে কিনা। নাকি বিশ্ববিদ্যালয় কেবলই হরে দরে সার্টিফিকেট?
গতবছর এমনই এক পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। সাংবাদিকদেও ওপর হামলা হয়৷ যে হামলার পর সাধারণ নিয়মেই সেটাকে ভিন্নখাতে নেওয়ার পরিকল্পনাও করা হয়। সাধারণ নিয়ম বলছি একারণেই যে ‘ক্ষমতাধর’রা হামলা করবেন তারপর সেটা ‘সরকারবিরোধী’ আন্দোলন হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার কাজটি করবেন। এবং প্রশাসন তদন্ত কমিটি করবে এবং সেই প্রতিবেদন কোনদিন সামনে আসার আগেই আমরা পুরো ঘটনাই ভুলে যাব। কিন্তু গতবছরের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেও ওপর ছাত্রলীগের হামলার ক্ষেত্রে সেটা করা সম্ভব হয়নি। যখন কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং এর উদ্যোগ নেন। আরাফাত সিদ্দিক: সাংবাদিক ও লেখক, আরিফ রেজা মাহমুদ : সাংবাদিক ও গবেষক, উদিসা ইসলাম: সাংবাদিক ও লেখক, ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল: গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী, জাহিদ জন: সাংবাদিক ও লেখক, বাধন অধিকারী: সাংবাদিক ও গবেষক, সালাহউদ্দীন সুমন: সাংবাদিক ও লেখক, সারোয়ার সুমন:সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মী মিলে তদনত্ম করে একটি প্রতিবেদন মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের কাছে জমা দেন৷ তিনি সেদিন স্বীকার করেন, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয় ঘটে থাকলে তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিবেন।
অরক্ষিত শিক্ষার্থীদের ওপর সেইদিন ছাত্রলীগ যখন হামলা চালায় তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চার সহকারি প্রক্টর তাতে নের্তৃত্ব দেন বলে সংবাদ মাধ্যমে তাদের ছবি প্রকাশিত হয়। এই চার সহকারী প্রক্টর হলেন- সিরাজুল ইসলাম, হেলাল উদ্দিন, জুলফিকার আলী, সাখাওয়াত হোসেন৷ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় শিক্ষাথির্রা হামলায় প্রকটোরিয়াল বডির অংশগ্রহনের অভিযোগ তোলেন৷ ফলে হামলায় সরসরি প্রশাসনের শিক্ষকদের অংশগ্রহনের আলামত পাওয়া গেছে। পুলিশ চালিয়েছে নির্বিচার হামলা। উপস্থিত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন তাদেও শান্তিপূর্ন অবস্থান কর্মসূচিতে হঠাৎ ছাত্রলীগ হামলা করলে আরেকদিক থেকে পুলিশ একইসাথে হামলা চালিয়েছে।
সশস্ত্র ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে একাধিক ভিডিও ফুটেজে পুলিশকে হেটে যেতে দেখা গেছে। পুলিশ সশস্ত্র ক্যাডারদের তাৎক্ষনিক গ্রেফতার করে নি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমাবেশকে হুমকি বা আশংকাজনক মনে করলে পুলিশ একশনের আগে সমাবেশকারীদের ওয়ার্নিং বা উঠে যাবার প্রকাশ্য আল্টিমেটাম দিতে পারত। তবে সে ধরনের কোন নোটিশ বা ঘোষণা দেয়া হয় নি।
এসব ঘটনা স্টিল ও ভিডিও ছবিসহ হাজির করার পরও শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলে কমিশনের ধর্তব্যে একবছরেও না আসাটা আমাদের ক্ষমতা কাঠামোর একধরনের ঔদ্ধত্যই বটে। সেই হামলা কেবল শিক্ষার্থীদের পিঠ গুলিতে ঝাজরা করেনি, শিক্ষার্থীর মাথায় লাগা গুলি চোখ নস্টের পায়তারা করেছে কেবল তাও না, একজোট হয়ে নিজেদেও যুক্তি অধিকারের কথা বলতে শিখছিলো যে ছাত্রসমাজ তাদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছে। আজ যখন সান্ধ্যকালীন কোর্স শুরু হওয়ার নানা বিজ্ঞাপন টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখা যায় সেই জেগে ওঠা শিক্ষার্থীদের অনুভুতি কী হয়?
সে শিখবে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে অপরাধ আমলযোগ্য না।
সে শিখবে বিশ্ববিদ্যালয় মুনাফাখোরির জায়গা।
সে শিখবে নিজেকে কিভাবে পুলিশের গুলি থেকে বাঁচিয়ে কেবল সার্টিফিকেট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়।
সে শিখবে কিভাবে তার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীরাও চুপ মেরে যেতে বাধ্য হয় একদিন।
মজার বিষয় হলো, প্রশাসন-সরকার-মালিক-দাতারা ভাবেন, শিক্ষার্থী শ্রমিক বা অধীনসত্মরা এমনটাই শেখে। সেই ভুল ভেঙেই বার বার জাগরণ ঘটে। আশ্বস্ত হবেন না, ভয় আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখে যে ক্যাডারদের আরও বেশি ‘শক্তিশালী’ করার কাজ আজকের প্রশাসন করছেন পরবর্তীদেও সেই ক্যাডারদেরই আঘাতের সম্মুখীন হতে পারেন তারাই। আর তখন পাশে থাকবে তাদেও এই সাধারণ শিক্ষার্থীরাই যারা আজকের মতো সেইদিনও ওই একই শেস্নাগানেই বিশ্বাসী থাকবে- – বিশ্ববিদ্যালয় মুনাফাখোরির জায়গা না।
Read FACT FINDING REPORT
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির সদস্যগণ:
- আরাফাত সিদ্দিক: সাংবাদিক ও লেখক
- আরিফ রেজা মাহমুদ : সাংবাদিক ও গবেষক
- উদিসা ইসলাম: সাংবাদিক ও লেখক
- ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল :গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী
- জাহিদ জন: সাংবাদিক ও লেখক
- বাধন অধিকারী: সাংবাদিক ও গবেষক
- সালাহউদ্দীন সুমন : সাংবাদিক ও লেখক
- সারোয়ার সুমন:সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মী