A.K.M Wahiduzzaman
ভূমিকা
বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। আক্ষরিক অর্থেই এই দেশটির জন্মদাত্রী মা হচ্ছে নদী। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ প্রায় ৭০০টি নদী-উপনদীর বয়ে আনা পলি লক্ষাধিক বছর ধরে জমে জমে এই দেশটির জন্ম হয়েছে। মাত্র ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দেশে নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪,১৪০ কিলোমিটার। স্বাভাবিকভাবেই দেশের উদ্ভিদ, প্রাণী তথা পুরো জীববৈচিত্র্যই হচ্ছে নদীনির্ভর। স্বল্প গভীরতার ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তরের কারণে আদ্র-উর্বর পলিমাটি এ দেশের মানুষের প্রধান পেশা হিসেবে কৃষিকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রতি বছর নদীগুলোর বয়ে আনা পলি পুষ্টি হিসেবে মাটিকে সমৃদ্ধ করে। নদীর মাৎস্য সম্পদ মানুষের প্রাণীজ প্রোটিনের একটি বড় অংশ যোগান দেয়। নদীর প্রবাহমান স্বাদুর পানির কারণেই সমূদ্র তীরবর্তী বাংলাদেশের লবণাক্ততার পরিমাণ কম। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ভূমি অনুপাতে জনসংখ্যা ধারণ ক্ষমতাও অনেক বেশি।
বাংলাদেশের প্রধান নদীর প্রায় সবগুলোর উৎসই দেশের বাইরে এবং এগুলো ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিগত কয়েক দশকে ভারতসহ উজানের দেশগুলো এই নদীর পানি প্রত্যাহার করার জন্য বিভিন্ন আবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সমালোচিত অবকাঠামো হচ্ছে ‘ফারাক্কা ব্যারেজ’ এবং ‘গজলডোবা ব্যারেজ’, ‘মহানন্দা ব্যারেজ’, ‘মেইডং ড্যাম’ এবং ভবিষ্যতের ‘টিপাইমুখ ড্যাম’/ ফারাক্কা ব্যারেজের ক্ষতিকর প্রভাব বাংলাদেশের মানুষ ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছে এবং ভবিষ্যতে চালু হবার অপেক্ষায় টিপাইমুখ ড্যামের সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে পূর্বাভাষ পেয়েছে। ইতিমধ্যেই চালু হয়ে যাওয়া ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য আরও ক্ষতির কারণ হতে যাচ্ছে। অথচ এই ক্ষতিকর অবকাঠামোর ক্ষতি মোকাবেলায় আমাদের দেশে কোনও জনসচেতনতামূলক প্রচার নেই। বরং নদীমাতৃক দেশে অপরিকল্পিত পানি ব্যবহার ও অবকাঠামো নির্মাণ করে আমরা নিজেরাই নদীবিমুখ পথে যাত্রা শুরু করেছি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে দুর্বল কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োগ, অপরিণত কৌশলগত ও আইনগত জ্ঞান আর বিভাজিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ একদিকে নির্মম প্রতিবেশীর স্বার্থপর পদক্ষেপসমূহের কারণে যেমন পানিশূন্য হচ্ছে, অন্যদিকে নিজের দেশের স্বার্থপর নাগরিকদের আগ্রাসনে নদীগ্রাস ও নদীদূষণের মাধ্যমে চরম পানি সংকটে পড়তে যাচ্ছে। দেশ ও জাতির এই অমূল্য সম্পদকে রক্ষা করতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য এখন দেশপ্রেমিক জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে।
[মানচিত্র-১: মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা লিংক প্রকল্প (উৎস: পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ভারত)]
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প
বিশ্বব্যাপী ২৬৩ টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫৪টি নদী ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে ৩৬টি নদীর ওপর ভারত মোট ৫৪টি ব্যারেজ এবং ড্যাম তৈরী করেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চলের বিভিন্ন নদীর “বাড়তি” পানি সংযোগ খালের মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের শুষ্ক এলাকার নদীগুলোতে সরবরাহ করে সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ভারতের তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী ড. কে. এল. রাও ভারতে পানি সরবরাহ গ্রিডের প্রস্তাব করেন। ১৯৮০ সালে আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় এবং ১৯৮২ সালে ‘ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি’ গঠন করে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। ভৌগোলিক ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত এই প্রকল্পের উত্তরাংশে হিমালয় অঞ্চল এবং দক্ষিণাংশে পেনিনসুলার অঞ্চল। এতে হিমালয় অঞ্চল থেকে ৬ হাজার ১০০ কিমি দৈর্ঘ্যের ১৪টি খাল ও ১৬টি জলাধার ব্যবহার করে মোট ১৪১.৩ বিলিয়ন কিউমেক (ঘনমিটার/সেকেন্ড) পানি দক্ষিণের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। ২০০৩ সালের আগস্টে স্বাধীনতা দিবসে ভারতের রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম এই পরিকল্পনা ত্বরিতগতিতে বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। ২০০৫ সালের মধ্যে সমীক্ষা শেষ হবার পর ২০০৬ সালে বিস্তারিত প্রকল্প দলিল তৈরি করে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। ইতিমধ্যে এই মহাপরিকল্পনা তাড়াতাড়ি বাস্তবায়নের জন্য ভারতের সুপ্রিমকোর্ট সরকারকে নির্দেশ দেন।
প্রকল্পের শুরুতেই ভারত-ভুটান সীমান্তের নিকটে ব্রহ্মপুত্রের উপনদী মানস এর উপর ৮,৭৫০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণক্ষম একটি এবং ব্রহ্মপুত্রের অপর উপনদী সংকোশ এর উপর ভারত-ভূটান সীমান্তের ১২ কিমি উজানে ৪,৯৩০ ঘনমিটার ধারণ ক্ষমতার আরেকটি ড্যাম নির্মাণ করা হবে। এরপর সংকোশ ড্যামের ১১ কিমি ভাটিতে সংকোশ ব্যারেজের মাধ্যমে সংযোগ খালে পানি সরবরাহ করা হবে।
[মানচিত্র-২: গঙ্গা-দামোদর-সুবর্নরেখা লিংক প্রকল্প (উৎস: পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ভারত)]
ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে গঙ্গায় পানি নেয়ার জন্য মোট ৪৫৭ কিমি দীর্ঘ ও ১০ মিটার গভীরতার মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ খাল ব্যবহার করা হবে, যার মাধ্যমে মানস ও সাংকোশ নদী থেকে ব্রহ্মপুত্রে পৌঁছানোর আগেই উজানের পানিকে গজলডোবায় তিস্তা ব্যারেজ এবং মহানন্দা ব্যরেজ হয়ে গঙ্গায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। ইতিমধ্যেই এই সংযোগ খালটির গজলডোবা হতে উত্তর দিনাজপুর পর্যন্ত অংশ নির্মাণের পর চালু করা হয়েছে।
এ ছাড়াও ১১ নং সংযোগ খালের মাধ্যমে মূল ব্রহ্মপুত্র নদীর জোগিঘোপায় ব্যারেজ নির্মাণ করে ৯৭.৫৩ কিমি সংযোগ খাল দিয়ে সংকোশ ব্যারেজে পানি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই পথে পানি স্থানান্তরের জন্য মোট ৫টি স্তরে ১,০৫৯ কিউসেক ক্ষমতার পাম্পের মাধ্যমে ১০০ মিটার উচ্চতায় পানি উঠানোর মতো উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাও রয়েছে।
গঙ্গায় পানি আনার পর ১৫ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ফারাক্কার দিকে প্রবাহিত করা হবে, যা ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় সেচ কাজে ব্যবহার করা হবে। ফারাক্কা থেকে ফারাক্কা-সুন্দরবন সংযোগ খালের (সংযোগ খাল-১২) মাধ্যমে ৯ বিলিয়ন ঘন মিটার পানি সরিয়ে নিয়ে যমুনার পুনরুজ্জীবন ও হুগলীতে স্থানান্তর করে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বাড়ানো হবে। এছাড়াও গঙ্গা-দামোদর-সুবর্ণরেখা সংযোগ খালের (সংযোগ খাল-১৩) মাধ্যমে সুবর্ণরেখা নদীতে এবং সুবর্ণরেখা নদী থেকে সুবর্ণরেখা-মহানদী সংযোগ খালের (সংযোগ খাল-১৪) মাধ্যমে মহানদীতে পানি স্থানান্তর করা হবে।
বাংলাদেশে নদীর পানির প্রয়োজনীয়তা ও প্রাপ্যতা
নদীমাতৃক দেশ হিসেবে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পানির প্রয়োজন অনেক বেশি। এই দেশে মানুষের গৃহস্থালী ও চাষাবাদের যতটুকু পানি প্রয়োজন হয় তার চেয়ে অনেক বেশি পানি প্রয়োজন হয় পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নদীর পানির প্রয়োজনীয় খাতগুলো হচ্ছে- সমুদ্রের লোনাপানিকে ঠেকানো, ভূ-গর্ভস্থ জলাধার পুনর্ভরন, বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা, পরিবেশ এবং চাষাবাদের জমিতে পুষ্টি সরবরাহ করা, মাৎস্য সম্পদের আবাসস্থল রক্ষা করা, নৌপথের নাব্যতা বজায় রাখা, গৃহস্থালী ও কল-কারখানায় পানির যোগান দেয়া।
[উপগ্রহচিত্র-১: ফারাক্কা ব্যারেজ (উৎস: কুইক ভিউ)]
বাংলাদেশে বাৎসরিক পানি প্রাপ্তির পরিমাণ কমবেশি ১,৪১৬ ঘন কিলোমিটার। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক নদীর মাধ্যমে পাওয়া যায় ৭৪% (১,০৫০ ঘন কিলোমিটার), বৃষ্টির পানি ২৪% (৩৪৩ ঘন কিলোমিটার) এবং ভূ-গর্ভ হতে উত্তোলিত হয় ২% (২৩ ঘন কিলোমিটার)/ নদী পরিবাহিত ১,০৫০ ঘন কিলোমিটার পানির পানির শতকরা ৮৫ ভাগই প্রবেশ করে জুন-অক্টোবর এই পাঁচ মাসে। আগত মোট পানির ৫৪% (৫৯৯ ঘন কিলোমিটার) সরবরাহ করে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী, গঙ্গা-পদ্মা সরবরাহ করে ৩১% (৩২৬ ঘন কিলোমিটার) এবং মেঘনা নদী সরবরাহ করে ১৫% (১৫৭ ঘন কিলোমিটার)/ বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুম ভেদে এই প্রবাহ নিম্নরূপ-
নদীর নাম | স্থান |
সর্বোচ্চ প্রবাহ (কিউমেক) |
সর্বনিম্ন প্রবাহ (কিউমেক) |
অনুপাত |
গঙ্গা | হার্ডিঞ্জ সেতু | ৭৬,০০০ | ৫২৬ | ০.৭ |
ব্রহ্মপুত্র | বাহাদুরাবাদ | ১,০২,৫৩৪ | ২,৮৬০ | ২.৭৯ |
মেঘনা | ভৈরব বাজার | ১৯,৮০০ | – | – |
উৎসঃ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (WARPO) |
উপরের উপাত্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানির উৎস হিসেবে গঙ্গা নদীর প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সুরমা-কুশিয়ারার উজানে বরাক নদীতে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণের পর এবং সারী নদীতে মেইডাং ড্যাম চালুর পর মেঘনা নদীর প্রবাহও কমে যাবে। সবেধন নীলমণি ব্রহ্মপুত্র হতেও যদি ভারত তার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে শুরু করে তাহলে বাংলাদেশ ভয়াবহ পানি সংকটে পড়বে।
ক্রমবর্ধমান হারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ইতিমধ্যেই দেশের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশংকাজনকভাবে নিচে নেমে গেছে। ঢাকা শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রতি বছর গড়ে প্রায় দশ ফুট করে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে আর সারা দেশে এই স্তর অবনমনের হার প্রায় দুই ফুট। পরিবেশ আইন এবং পানি নীতি লঙ্ঘন করে ক্রমবর্ধমান হারে জলাভূমি ভরাট করার কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানি পুনর্ভরণের হার কমে যাচ্ছে। যথেচ্ছভাবে নদী এবং খাল দখল করার পাশাপাশি শিল্প ও মানবিক বর্জ্য দিয়ে নদীর পানিকে ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলা হচ্ছে। উজানে পানি প্রত্যাহারের পাশাপাশি এইসব দেশীয় পদক্ষেপ আসন্ন পানি সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলছে।
[উপগ্রহচিত্র-২: গজলডোবা ব্যারেজ (উৎস: কুইক ভিউ)]
ইতিমধ্যে গৃহীত সরকারী পদক্ষেপসমূহ
সত্তরের দশকে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হবার পরই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে বিষয়টি মোকাবেলার পাশাপাশি ভূ-পৃষ্ঠস্থ জলাধার সৃষ্টির জন্য সি.এস মানচিত্র অনুযায়ী সারাদেশে খাল পুনঃখনন কর্মসূচি চালু করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সরকারের আমলে এই কর্মসূচি পরিত্যক্ত হয় এবং পুনঃখননকৃত খালগুলোর অধিকাংশই দখল হয়ে যায়। গঙ্গার পানিবণ্টন বিষয়ে ১৯৭৭ এবং ১৯৯৬ সালে দু’টি চুক্তি এবং ১৯৮২ ও ১৯৮৫ সালে দু’টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়, যদিও সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে কোনও গ্যারান্টি ক্লজ না থাকায় বাংলাদেশ ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা হতে বঞ্চিতই থাকবে। অন্যদিকে চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ এখনো তিস্তা নদীর পানির অধিকার হতে বঞ্চিত রয়েছে এবং সারী নদীতে মেইডং ড্যাম ও বরাক নদীতে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
১৯৯৯ সালে সর্ব প্রথম বাংলাদেশের জন্য সরকারী পানি নীতি প্রণয়ন করা হয়। এরপর ২০০৯, ২০১০ এবং ২০১২ সালে পানি আইনের তিনটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়। পানি নীতি এবং পানি আইনের খসড়ায় বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
১. পান, পরিচ্ছন্নতা এবং পয়োনিষ্কাশনের জন্য পানিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া;
২. সেচ ও নাগরিক ব্যবহারে পানি সরবরাহের জন্য ভূ-পৃষ্ঠস্থ, ভূ-গর্ভস্থ এবং বৃষ্টির পানির সমন্বিত ব্যবহারে গুরুত্ব দেয়া;
৩. পরিযায়ী পাখির চারণভূমি বিবেচিত জলাশয় সংরক্ষণ ও সেখানে বর্জ্য নিষ্কাশন রহিত করা;
৪. পানিসম্পদ বিষয়ক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে প্রাকৃতিক নিষ্কাশনকে বিবেচনায় রাখা বাধ্যতামূলক করা;
৫. অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার অনুমোদিত পানি ব্যবস্থাপনা সংগঠন গঠন ও তার নিয়মাবলী প্রণয়ন;
৬. পানি আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ চিহ্নিতকরণ এবং শাস্তি ও জরিমানা নির্ধারণ।
পানি নীতি ও প্রস্তাবিত আইনের সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে চলমান বা আসন্ন সংকট নিরসনের বিষয়ে কোনও নির্দেশনা বা নীতি এখানে উল্লেখ করা হয় নি, যা আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও অন্যান্য দুর্বল দিকগুলো হচ্ছে-
১. পানি সম্পদকে সরকারী মালিকানাধীন করে গৃহস্থালী ও কৃষিকাজে জনগণের সীমিত অধিকারের কথা বলা হলেও এর সুনির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি;
২. ভূ-পৃষ্ঠস্থ, ভূ-গর্ভস্থ এবং বৃষ্টির পানির সমন্বিত ব্যবহারে গুরুত্ব আরোপ করা হলেও কোন উৎস হতে কী পরিমাণ পানি ব্যবহার করা যাবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি;
৩. পানিসম্পদ বিষয়ক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে প্রাকৃতিক নিষ্কাশনকে বিবেচনায় রাখা বাধ্যতামূলক করা হলেও সরকারী ও বেসরকারী আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত করার বিষয়ে কোনও দিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি;
৪. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের অনুমতি দেয়া হলেও এ বিষয়ে পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয় নি এবং ‘বন্যার সাথে বসবাস’ নীতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি;
৫. পানি আইনের আওতায় শাস্তি ও জরিমানার বিধান রাখা হলেও কোন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এই শাস্তি কার্যকর হবে সে বিষয়ে কোনও দিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি; এবং
৬. সরকারী পানি সম্পদ বিষয়ক প্রকল্পের কারণে সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রকল্প প্রণয়নকারীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে সে বিষয়ে কোনও দিক নির্দেশনা দেয়া হয় নি।
সংকট মোকাবেলায় ভবিষ্যতে গৃহীতব্য পদক্ষেপ
বাংলাদেশের ভবিষ্যত পানি সংকট মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত অপ্রতুল ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে আরো যে সকল পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলো।
(ক) কূটনৈতিক ও আইনগত পদক্ষেপ: আন্তর্জাতিক নদীর পানি সমবণ্টনের মাধ্যমে ব্যবহারের জন্য নীল, দানিয়ুব, মেকংসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর জন্য যেভাবে চুক্তি করা হয়েছে, সেভাবে চুক্তি করার জন্য ভারতের উপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে হবে। সিন্ধু নদীর পানি ব্যবহারের জন্য ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যে ধরনের চুক্তি হয়েছে, সেই একই আদলে বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন চুক্তি করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। গত ২৪ জুলাই ২০১২ ভারতে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে কোনও অভিন্ন নদী হতে পানি প্রত্যাহার করা হবে না। অথচ ইতিমধ্যেই ভারত এই প্রকল্পের অধীন তিস্তা ও মহানন্দাসহ ছয়টি নদী হতে পানি প্রত্যাহার করতে শুরু করেছে। এই ভুল তথ্য প্রদানের জন্য ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাতে হবে।
[উপগ্রহচিত্র-৩: মহানন্দা ব্যারেজ (উৎস: কুইক ভিউ)]
জাতিসংঘের ‘আন্তর্জাতিক জলধারায় অ-নৌচলাচল পানি ব্যবহার আইন সংক্রান্ত কনভেনশন ১৯৯৭’ ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়েই গ্রহণ করেছে। এই কনভেনশনের ৫(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে সমতাপূর্ণ ও যৌক্তিক উপায়ে আন্তর্জাতিক নদীর পানির সর্বোচ্চ এবং টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত না করা, অনুচ্ছেদ ৬(১) অনুসারে পানি প্রবাহের সংরক্ষণ, নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত না করা, অনুচ্ছেদ ৭ অনুসারে পানি প্রবাহ সংশ্লিষ্ট ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের ক্ষতিসাধন এবং অনুচ্ছেদ ৯ অনুসারে পানি প্রবাহের অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য বিনিময় না করার কারণে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অভিজ্ঞ আইনজীবী ও পানি বিশেষজ্ঞ প্যানেল নিয়োগ দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে।
(খ) পানি সম্পদ ব্যবহারে পদক্ষেপ: বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত পানি ধরে রাখার জন্য দখল হয়ে যাওয়া নদী ও খালগুলো পুনরুদ্ধার করে খনন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই দেশি-বিদেশি অর্থায়নে ৫০টি জেলার প্রতিটি উপজেলায় চারটি করে প্রায় এক ১,৫০০ খাল খনন করার কাজ শুরু করেছে। তবে দুর্নীতির কারণে এই মহাপরিকল্পনাটি শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। অধিকাংশ স্থানেই এক্সকাভেটর দিয়ে খালের বদলে নালা খনন করা হচ্ছে এবং নদীগুলোকে আরো সংকীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে।
বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য পুরাতন পুকুর ও জলাশয় সংষ্কারের পাশাপাশি নতুন পুকুর ও জলাশয় খনন করতে হবে। পানি নীতি ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন সীমিতকরণের পাশাপাশি জলাভূমি ভরাট করার বিরুদ্ধে শক্তি পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্যার পানি ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই গঙ্গা ব্যারেজ নির্মানের পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। দীর্ঘ মেয়াদে সেই প্রকল্পের কথাও মাথায় রাখা যায়।
(গ) পানি সংকট অভিযোজনে পদক্ষেপ: উজান হতে পানি সরবরাহ কমে গেলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভিযোজনের জন্য পানির অপব্যবহার রোধ করার জন্য জন সচেতনতা সৃষ্টি করতে এখন হতেই জনসচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণার পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সাথে উপকূলীয় এলাকায় ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার সাথে অভিযোজনের জন্যও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের কৃষিবদগণ ইতিমধ্যেই স্বল্প পানিতে উৎপাদনক্ষম এবং লবণাক্ত পানিতে উৎপানক্ষম ধানের প্রজাতি উদ্ভাবন করেছেন। ভবিষ্যতে তাঁরা এই ধরনের অন্যান্য ফসলের প্রজাতি উদ্ভাবন করবেন বলে আশা করা যায়।
উপসংহার
পানির অপর নাম জীবন। জীবনের এই অপরিহার্য উপকরণের সুরক্ষায় দেশি বিদেশি সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে জনমত তৈরি করা আমাদের সকলের কর্তব্য। এই বিষয়ে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে একযোগে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র ভারত বিরোধিতার জন্য পানি সংকট ইস্যুকে ব্যবহার না করে অথবা ভারত প্রীতির কারণে দেশটিকে পানি প্রত্যাহারের একতরফা সুযোগ দিয়ে পানি সংকট উপেক্ষার নীতি না নিয়ে দেশের স্বার্থে সঠিক ও ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়ার এটাই শেষ সময়।
[This Post was previously published in Priyo.com]