একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গীতিকার গোবিন্দ হালদারের লেখা সেই অবিস্মরণীয় গানগুলো হলো- ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে…’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে…’, ‘পূর্ব দিগন্তে সুর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল…’, ‘লেফট রাইট লেফট রাইট…’, ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার…’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা…’, ‘চল বীর সৈনিক…’, ‘হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার বাংলার মাটি…’।
এ রেড স্যালুট টু গোবিন্দ হালদার
-রেজা ঘটক
প্রখ্যাত গীতিকার গোবিন্দ হালদার আর নেই।
আজ ১৭ জানুয়ারি ২০১৫, শনিবার, কলকাতার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার মানিকতলার জিতেন্দ্রনাথ রায় হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে এই মহান গীতিকবি’র বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি কিডনি, গ্লুকোমা ও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন লাখ লাখ মানুষ জীবন বাঁচাতে এপার বাংলা ছেড়ে ওপার বাংলায় ছুটেছিল, তখন আকাশবাণী রেডিও সহ খবরের কাগজে নিয়মিত প্রচারিত হতো পাকবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের খবর। তখন কলকাতার সর্বস্তরের মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরাও তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কলম ধরেছিলেন।
সেই সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন কলকাতার গীতিকবি গোবিন্দ হালদার। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪১ বছর। তখন তিনি কলকাতায় আয়কর বিভাগে চাকরি করতেন। আর অবসরে লিখতেন কবিতা আর গান।
এক সাক্ষাৎকারে গোবিন্দ হালদার বলেছিলেন, “আমার এক বন্ধু ছিলেন। নাম কামাল আহমেদ। কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। থাকতেন কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকার ঝাউতলা রোডে। কামালের স্ত্রী ঢাকা বেতারের উর্দু বিভাগে কাজ করতেন। এখন তাঁরা থাকেন কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে। একদিন কামাল আমাকে বললেন, “তুমি তো ভালো গান লেখো। এবার তুমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর কিছু গান লেখো। আমি তা স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারের ব্যবস্থা করে দেব।”
আয়কর বিভাগে কর্মরত থাকার মধ্যেই আকাশবাণীর তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসেবে নিয়মিত গান লিখতাম। কামালের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করি গান লেখা। একটি লাইনটানা খাতায় একের পর এক লিখে ফেলি ১৫টি গান। কামাল আমার গানের কলি দেখে দারুণ খুশি। আমাকে নিয়ে গেলেন স্বাধীন বাংলা বেতারের অন্যতম কর্ণধার কামাল লোহানীর কাছে। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর তার হাতে তুলে দেন ওই গানের খাতাটি।
This song was recorded in Kolkata during the Liberation War of Bangladesh. Lyrics: Gobinda Halder. Music: Sufika Chowdhury.
একদিন হঠাৎ শুনতে পাই আমার লেখা “পূর্ব দিগন্তে সুর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল”−গানটি স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত হয়েছে। গানটির সুর দিয়েছিলেন প্রয়াত সুরকার সমর দাস। এরপর আবার ভেসে আসে, “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি” গানটি। তারপর আরও কটি গান।
আর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর সম্ভবত ২৩ কিংবা ২৪ ডিসেম্বর ভেসে আসে সেই অবিস্মরণীয় গানটি, “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা” গানটি। তখন কী যে আনন্দ আমার! গানটির সুর দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও শিল্পী আপেল মাহমুদ।
আপেল মাহমুদ তখন শিয়ালদহ স্টেশনের পূরবী সিনেমার পাশে মহাত্মা গান্ধী রোডের শ্রীনিকেতন বোর্ডিংয়ে থাকতেন। এখন অবশ্য ওই বোর্ডিংয়ের নাম বদলে গেছে। আপেল মাহমুদ সে সময় আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন। মনে আছে, আমি ২১ ডিসেম্বরের দিকে আপেল মাহমুদের সেই বোর্ডিংয়ে যাই। তখন তিনি গানটি আমাকে গেয়ে শোনান। দারুণ লেগেছিল। আমার যতটুকু মনে পড়ে, একাত্তরের ২৩ কিংবা ২৪ ডিসেম্বর গানটি প্রথম প্রচারিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতারে। গানটির লিডিং ভয়েস ছিল স্বপ্না রায়ের। আর কন্ঠ দিয়েছিলেন আপেল মাহমুদ ও সহশিল্পীরা।
”Ek Sagor Rakter Binimoye” — Lyrics – Gobinda Halder, Composition – Apel Mahmud, Singers – Swopna Roy, Apel Mahmud & Others, Film – Ora 11 Jon (1972).
এখন স্বপ্না রায় কোথায় আছেন জানি না। স্বপ্না রায়ের বাড়ি ছিল কুমিল্লায়। তখন স্বপ্না রায়ের বয়স ছিল ২১-২২ বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় মা-বাবাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতেই ছিলেন স্বপ্না রায়। পাশের রুমে বসে গানের রেওয়াজ করতেন। পরে অবশ্য ওরা সোদপুর তারপরে দুর্গাপুর চলে যান। স্বপ্না রায়ের এক দাদা ছিলেন। তিনি চা-বাগানে চাকরি করতেন। আমি ১৯৭২ সালে কুমিল্লায় স্বপ্না রায়ের বাড়িতে বেড়াতেও গিয়েছিলাম। বাঁশের বেড়ার বাড়ি ছিল। পরে শুনেছি ঢাকার এক শিল্পীর সঙ্গে তার কলকাতায় রেজিস্ট্রি বিয়েও হয়। একসময় তিনি ঢাকায় চলে যান।
বাংলাদেশ বেতার ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমার লেখা সাতটি গান প্রচার করা হয়েছিল। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃক রেকর্ড করা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের গানের একটি লং প্লে রেকর্ডে আমার লেখা তিনটি গান ঠাঁই পায়। এছাড়া ১৯৭২ সালে এইচএমভি ‘বিক্ষুব্ধ বাংলা’ নামের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি গীতি-আলেখ্যের লং প্লে রেকর্ডে আমার লেখা দুটি গান ঠাঁই পায়। এইচএমভি একই বছর বের করে ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ নামের আরেকটি লং পে রেকর্ড। তাতেও স্থান পায় আমার লেখা “পূর্ব দিগন্তে সুর্য উঠেছে” গানটি। আমার অন্তত ৪০টি গান প্রচারিত হয়েছে আকাশবাণীতে। আর স্বাধীন বাংলা বেতারে সাতটি। আমি তখন আকাশবাণীর তালিকাভুক্ত গীতিকার ছিলাম।”
”Mwora Ekti Phulke Bachabo Bole Juddho Kori” — Bangla Patriotic Song. A famous song of ‘Swadheen Bangla Betar Kendro’ in 1971. Lyrics – Gobindo Haldar. Composition – Apel Mahmud. Singer – Apel Mahmud.
একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গীতিকার গোবিন্দ হালদারের লেখা সেই অবিস্মরণীয় গানগুলো হলো- ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে…’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে…’, ‘পূর্ব দিগন্তে সুর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল…’, ‘লেফট রাইট লেফট রাইট…’, ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার…’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা…’, ‘চল বীর সৈনিক…’, ‘হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার বাংলার মাটি…’।
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গানটি সুর করেছিলেন বিখ্যাত সুরকার শিল্পী সমর দাস। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানটি সুর করেছিলেন প্রখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ। আর গানে মূল কণ্ঠ দিয়েছিলেন স্বপ্না রায়। পরে শিল্পী আপেল মাহমুদ ও সহশিল্পীরা এটি গেয়েছেন।
গীতিকবি গোবিন্দ হালদার ১৯৩০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন। চাকরি সূত্রে প্রায় ৫০ বছর আগে তিনি কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। বসবাস করতেন কাঁকুরগাছি এলাকার রামকৃষ্ণ সমাধি রোডের এক সরকারি আবাসনের একচিলতে কোঠায়। সঙ্গে থাকতেন তাঁর স্ত্রী। একমাত্র কন্যা গোপা হালদারের বিয়ে হয়ে গেছে। সরকারি পেনশন নিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো এভাবেই কাটিয়ে দেন তিনি। ছেড়ে যাননি এই সরকারি আবাস।
দীর্ঘদিন তিনি বার্ধক্যজনিত নানান জটিলতায় ভুগছিলেন। কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। গ্লুকোমায় আক্রান্ত হয়ে তাঁর ডান চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শরীরও ভেঙে পড়েছিল। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর কিডনির অসুস্থতাজনিত কারণে গোবিন্দ হালদারকে কলকাতার মানিকতলার জিতেন্দ্রনাথ রায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ শনিবার স্থনীয় সময় সকাল ১০টা ২০ মিনিটে এই হাসপাতালেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত গীতিকবি গোবিন্দ হালদারের গানগুলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অসুস্থ গোবিন্দ হালদারকে দেখতে কলকাতার মানিকতলার জিতেন্দ্র নাথ রায় হাসপাতালে গিয়েছিলেন। ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশের উপহাইকমিমনার জকি আহাদকে দিয়ে তাঁর চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য পাঠিয়েছিলেন।
যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, ততদিন গীতিকবি গোবিন্দ হালদার বাংলাদেশের মানুষের কাছে চিরসম্মরণীয় হয়ে থাকবেন। হে মহান কবি আপনি যেখানে থাকুন, ভালো থাকুন। আপনার আত্মা চির শান্তিতে থাকুক। জয়তু গোবিন্দ হালদার। জয়তু বাংলাদেশ।।
…………………………
১৭ জানুয়ারি ২০১৫
ঢাকা
It is a big loss for Bangladesh. Gobindo Halder was a talented person. He had strong talent on song.