সাম্প্রদায়িকতা সমাচার: আমার জানা, বোঝা আর শেখার গল্প
by Partha Sarker for Alalodulal
আলোচনার জটিলতা
সাম্প্রদায়িকতা’র বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা একটু জটিল। দুটো কারণে:
এক: এই বিষয় নিয়ে একটা নির্মোহ আলোচনা করার জন্য যে দূরত্বের দরকার হয়, সেটা আমার মতো একজন মানুষের পক্ষে অর্জন করা সব-সময় খুব সহজ হয় না।
দুই; বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার এত ভিন্ন ভিন্ন স্তর বা ডাইমেনশন আছে যে কথা শুধু এক স্তর নিয়ে বললে হয় না, সেটা একপেশে থাকে।
এর বাইরেও আরেকটা দিক হলো – সাম্প্রদায়িকতা’র বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হয় তখনই যখন কোনো সাম্প্রদায়িক হামলার মত ঘটনা ঘটে – যেটা আরেকটা সমস্যা। তখন ইস্যুটা থাকে হয় শান্তি প্রক্রিয়া- শান্তি, শান্তি, আমরা সবাই ভালো মানুষ নতুবা হয় কাদা ছোড়াছুড়ি, আওয়ামীলীগ না বিএনপি দায়ী – এইসব, এইসব। এরকম আগুন নেভানো সময়ে শেকর সন্ধানী আলোচনার সুযোগ থাকে কম।
তবুতো শুরু
জিয়া হাসানের সাহসী লেখাটা অনুপ্রানিত করলো নিজের দেখা বা উপলদ্ধি করা কিছু বিষয় সোজা-সাপ্টা ভাবে বলতে। সমস্যা এবং সমাধানটা কোথায় সেটা জানার জন্য সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কোনো রকম প্রি-অকুপেশন ছাড়া একটা সৎ আলোচনা শুরু হওয়া দরকার এবং সেই আলোচনা হওয়া প্রয়োজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিভিন্ন শ্রেনীকে যুক্ত করেই কারণ সাম্প্রদায়িকতার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে শ্রেণীও একটা ফ্যাক্টর। আমি রাজনৈতিক নেতাদের প্রায়ই বলতে শুনি ‘আমাদের দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ’ – আমার মনে হয় এই statement’ টা ভ্যালিডেট করা উচিত একমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের দ্বারা – তারা কি ফীল করছেন – সেটাই হওয়া উচিত ইনডিকেটর।
দেখার ভিন্নতা: শ্রেণী, সময় এবং অবস্থান
এটাও ঠিক ভুক্তভোগী না হলে সাম্প্রদায়িকতার মূলে যাওয়া একটু কঠিন। আমিও আজ প্রবাসে বসে যেভাবে বিষয়গুলো দেখছি, অভয়নগরের মালো পাড়ার কিংবা রামু’র সর্বস্স্ব হারানো মানুষগুলি, মফস্বলের এক উঠতি তরুণ উদ্যোক্তা যিনি হয়ত ধর্মীয় সম্প্রদায়গত ভাবে সংখ্যালঘু, গ্রামের একজন কলেজগামী তরুণী যাকে হয়তো একাই কলেজে যেতে হয়, একজন আদিবাসী যাকে হয়ত বাঙালী পাড়ায় গিয়ে পণ্য বিক্রি করতে হয়, ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এক হিন্দু কর্পোরেট চাকরিজীবি কিংবা উচ্চবিত্ত এক সংখ্যালঘু ব্যবসায়ী যাকে হয়তো প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী অফিসের সাথে কাজ করতে হয় – তারা সবাই হয়তো সাম্প্রদায়িকতাকে একই ভাবে একই জায়গা থেকে দেখবেন না। স্থান এবং সময়ও সেখানে একটা ভূমিকা পালন করে। প্রবাসে আমি আমার এক বন্ধুকে এমনও বলতে শুনেছি, দেশে থাকতে ধর্মীয় সংখ্যা-লঘুদের দুঃখ-দুর্দর্শা বুঝতে পারতাম না, কিন্তু আজ বিদেশে এসে নিজে সংখ্যা-লঘু হয়ে বিভিন্ন বঞ্চনার ভিতর দিয়ে কিছুটা বুঝতে পারি। সময়ের সাথে সাথে চিন্তার পরিবর্তন হয়, আমার নিজের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। কিভাবে, সেটা নিচে বলার চেষ্টা করছি কিন্তু তার আগে দেখা দরকার বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার অভিজ্ঞতা গুলো ঠিক কি ধরনের?
সহজ চোখে সাম্প্রদায়িকতার স্তর-বিন্যাস
সাম্প্রদায়িকতাকে আমি অভিজ্ঞতা এবং অবস্থানের ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করার চেষ্টা করছি:
১. সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস
২. সাম্প্রদায়িক হেনস্থা
৩. সাম্প্রদায়িক বিষেদাগার
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস
যশোর, দিনাজপুরে আজ যেটা হচ্ছে, ২০০১ সালে নির্বাচনের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যেটা হয়েছে, সেটাকে মোটা দাগে আমরা ‘সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস’ বলতে পারি – যেখানে মানুষের জীবন, জীবিকা, সম্ভ্রম চরম হুমকির মুখে। এই সন্ত্রাস একমুখী এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রান্তিক, শ্রমজীবি, দরিদ্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ এর স্বীকার। প্রান্তিক নারীরা বিশেষ করে খুবই হুমকির মুখে থাকে। ২০০১ সালে সংখ্যালঘু নির্যাতনের উপর গঠিত কমিশন ২০০১’র অক্টোবরে নির্বাচনের পর থেকে পরবর্তী ১৫ মাস ২০০’র অধিক ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড করেছিলেন . আমি নিজে কখনো এর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ভিকটিম হইনি কিন্তু ঢাকায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের একটা নির্মম রূপ দেখেছিলাম ৯১’এ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর পর। দেখেছিলাম পুরানো ঢাকায় ষ্টার সিনেমা হলের পাশে পুড়ে যাওয়া ‘দি হোমিও রিসার্চ ল্যাবরেটরি’র বিশাল দোকান – যার পোড়া স্পিরিটের গন্ধ দীর্ঘদিন ওই এলাকার বাতাসকে ভারী করে রেখেছিলো, ইসলামপুরের মাথায় স্বনামধন্য যন্ত্র সংগীতের দোকান ‘যতীন এন্ড কোং’ যার কোনো সঙ্গীত যন্ত্র আর অক্ষত ছিল না কিংবা সদরঘাটের মোড়ে বহু পুরানো ব্রাম্হ সমাজের লাইব্রেরির দুষ্প্রাপ্য বইয়ের পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তুপ। এই জায়গাটার একটা ঐতিহাসিক মুল্য আছে, এই ব্রাম্হ সমাজ মন্দিরে একদিন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, কবি জীবনানন্দ দাসের বিয়েও হয়েছিল এখানে। সত্যি বলতে কি, সম্ভাব্য বিপর্যয়ের চিন্তায় সেদিন আমি আমার পিতা-মাতার চোখে ৭১’র বিভীষিকাই দেখেছিলাম। জীবন, জীবিকার উপর নানামুখী নীরব-সরব সন্ত্রাসে গ্রামগুলোতে এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন কমে যাচ্ছে, যারা হয়ত জমি-জমা হারিয়ে কিংবা বিক্রি করে ভিড় করছেন নিকটবর্তী মফস্বল শহরগুলোতে। বাংলাদেশ সেন্সাস ১৯৯১ এবং ২০০২’র উপর ভিত্তি করে তৈরী করা এই হিন্দু জনসংখ্যার জেলাঅয়ারি অবস্থান হয়তো কিছুটা ধারণা দিবে। যারা চলে যাচ্ছেন তাদের কোনো হিসাব রাখা হয় না কিন্তু এই টেবিল থেকে বোঝা যাচ্ছে হিন্দু জনসংখ্যা যেখানে ১৯৪১ সালে ছিলো ২৮%, ২০০১ সালে তা নেমে এসেছে ৯.৬ শতাংশে । জাতীয় পর্যায়ে একসাথে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে কমই হয় বরং এর বিস্তৃতি অনেকটা স্থানীয় পর্যায়ে। একভাবে দেখতে গেলে এই সন্ত্রাস সাধারণ মানুষের বিচারহীনতার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের একটি অংশ মাত্র, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যেখানে আরো অসহায়। এই স্থানীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের একটি সাম্প্রতিক প্রবণতা হলো গুজবের মাধ্যমে একটি যৌক্তিকতা তৈরী করে স্থানীয় মানুষদের মুখোমুখি দাঁড় করানো এবং পিছন থেকে একটি পরিকল্পিত, সংঘবদ্ধ আক্রমন পরিচালনা করা। কক্স-বাজারের রামুতে বৌদ্ধ-পল্লীর উপর পরিকল্পিত আক্রমন একটি উদাহরণ।
সাম্প্রদায়িক হেনস্থা
ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের ব্যক্তিগত কিংবা কর্মজীবনে বিপর্যয় কিংবা হুমকি তৈরী করার মত অবস্থাকে ‘সাম্প্রদায়িক হেনস্থা’ বলা যেতে পারে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু যারা প্রান্তিক শ্রমজীবি এবং শহুরে মধ্যবিত্ত উভয়েই এর শিকার হতে পারেন। সাম্প্রদায়িকতার কারণে চাকরি না হওয়া, প্রমোশন না হবার কিংবা অন্য কোনো অধিকার বঞ্চিত হবার মত বহু ঘটনা আমি শুনেছি। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চ-পদে কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ ছিলেন না। অনেক সংখ্যালঘু মানুষ ভাবতেন সরকারী প্রতিষ্ঠানে তারা নানারকম হেনস্থার সন্মুখীন হবেন। সেটা সব জায়গায় সত্য না হলেও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে আমার একবার অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। সেটা বোধ হয় ২০০৫ সালে। আমার একটা ডকুমেন্ট অফিডেভিট করার প্রয়োজন হয়। আমার এক বন্ধুর বাবা সুপ্রিম কোর্ট আপিলেট ডিভিশনের আইনজীবী হওয়াতে উনিই আমাকে বললেন সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে চলে আসতে। আমি যাবার পর আমার কাগজটা উনি উনার সহকারীকে দিয়ে নিচে নোটারি পাবলিক অফিসে পাঠিয়ে আমার সাথে বসে গল্প করছিলেন কিন্তু অনেকক্ষণ পর উনার সহকারী এসে জানান, আমার কাগজটা নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু নীচের অফিস সন্দেহ করছিলো আমি কি সেই শৈবাল সাহা পার্থ কিনা যাকে ২১শে অগাস্ট গ্রেনেড হামলার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিলো! এই শৈবাল সাহা পার্থ ছেলেটিকে একটা মিথ্যা সন্দেহে গ্রেফতার, নির্যাতন করে পরিবারটিকে এক নিদারুন অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয়েছিলো এবং অধিকাংশ সংখ্যালঘু পরিবার কিন্তু সেটাকে কিন্তু একটা বার্তা হিসাবেই নিয়েছিলো। জমি নিয়ে বিরোধ একটা খুব কমন হেনস্থার একটা জায়গা। ্ড: আবুল বারাকাত তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন দীর্ঘ ৪০ বছরে শুধুমাত্র এক ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’র (পুরানো শত্রু সম্পত্তি আইন) মাধ্যমে প্রায় ১২ লক্ষ পরিবার ২৫ লক্ষ একরের উপর জায়গায় হারিয়েছেন। যশোর মালোপাড়ার কথাই ধরুন। সম্প্রতি এই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ভ্রমন করেছেন এমন একজন ব্লগার কাছ থেকে জানা যাচ্ছে – ‘পুরো পাড়ায় চাকরি করেন মাত্র দু’জন, একজন বিমান বাহিনীতে ছোটখাট একটা পদে, অন্যজন একটা স্থানীয় বিদ্যালয়ে। বিদ্যুৎ নেই, পাশের ‘মুসলমান পাড়া’ থেকে লাইন টেনে আলো জ্বালান। অবিশ্বাস্য হারে তাদের বিল দিতে হয় মূল গ্রাহককে: পাঁচটি বাতির জন্য ১৮শ’ থেকে ২২ শ’ টাকা। নিকটতম পাঠশালা তিন কিলোমিটার দূরে’। এই অবস্থায় দেখা যাচ্ছে এই জেলে সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য সবার আগে আক্রান্ত হচ্ছে তাদের জীবিকার মাধ্যম – ‘দরোজা ভেঙে তছনছ করা হয়েছে আসবাব, সিন্দুক ভেঙে লুট করা হযেছে টাকা পয়সা আর অলঙ্কার। বিশেষ ক্ষোভ ছিমাছ ধরার জালগুরোর ওপর’।
সাম্প্রদায়িক বিষেদাগার
কথা কিংবা আচরণের মাধ্যমে সম্প্রদায়গতভাবে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে আমি ‘সাম্প্রদায়িক বিষেদেগার’ বলছি। শ্রেণী অবস্থানগতভাবে সকলেই এতে আক্রান্ত হতে পারেন তবে প্রান্তিক, দরিদ্র মানুষকেই এর সাথে প্রতিবাদহীন অভিযোজন করতে হয়। শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের তবু হয়ত কিছু সীমিত ক্ষমতা আছে তার অবস্থান, পরিবেশ কিংবা সঙ্গ পরিবর্তন করার, প্রতিবাদ করার, প্রশাসনকে অবগত করার। ‘মালাউন’ শব্দটা প্রথম শুনি আমি যখন খুব ছোটো। আমারই এক বন্ধু ফুটবল খেলায় হেরে গিয়ে আমাকে এই গালিটা দেয়। আমরা তখন জানতাম না এটার মানে কি? তাই শিশুসুলভ চপলতায় আমরা সবাই তখন একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ‘মালাউন, মালাউন’ বলে চিত্কার করতে করতে বাড়ি চলে আসি। পরে যখন বুঝতে শিখেছি তখন আরেকটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতাম – ‘তোমরা তো হিন্দু, কবে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছো?’ আমার এই প্রশ্নটা শুনলেই বহুদিন আগে সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে প্রকাশিত একটি স্মরণিকায় মোস্তফার জামান আব্বাসীর’ একটা লেখার কথা মনে পড়ে যায়, হুবুহু মনে নেই কিন্তু সারমর্ম টা ছিলো এরকম – উনি যখন স্কুলে পড়তেন তখন তিনি বরাবরই তৃতীয় স্থান পেতেন কারণ প্রথম দুটি স্থান বরাদ্দ ছিলো অন্য দুই মেধাবী ছাত্রের জন্য যারা ছিলেন ধমীয় সম্প্রদায়গত ভাবে হিন্দু। তিনি ছিলেন তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, খুব মিশতেন কিন্তু শত চেষ্টা করেও কোনভাবেই তাদের পরীক্ষায় টপকাতে পারেন নি। এর মধ্যেই একদিন ৬৪’র দাঙ্গা এলো, তিনি দেখলেন তার ওই দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর স্কুলে আসছে না। প্রথম তিনি ভাবলেন হয়ত নিরাপত্তার কারণে ওরা আসছে না কিন্তু ক্রমশ যখন আরো অনেকদিন চলে গেল, উনি তার বন্ধুদের বাসায় গিয়ে জানতে পারলেন – ওরা আক্রমনের ভয়ে পরিবারসহ ভারত চলে গেছে আর কখনই ফিরবে না। এভাবেই ডিসেম্বরে ফাইনাল পরীক্ষা এলো, রেজাল্ট বের হলো, আব্বাসী ভাই দেখলেন উনিই ফার্স্ট হয়েছেন। তারপর তিনি লিখছেন – ‘সবাই চলে যাবার পর এমন ফার্স্ট হতে তো আমি চাই নি।’ আমি এই গল্পটা তুললাম এই কারণেই অনেকেই হয়তো এটা বুঝতেই পারেন না একজন মানুষ শুধু কতটুকু কষ্ট আর অনিরাপদ বোধ করলে রাতারাতি সব কিছু ছেড়ে দেশ ছাড়ার সিদ্বান্ত নিতে পারেন। একবার আমি বাসে করে বন্ধুদের সাথে কলকাতা যাচ্ছি, তখন ঢাকা-কলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। বোধ হয় মানিকগঞ্জ থেকে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা উঠলেন বাসে। ভদ্রলোক ধূতি পরিহিত, অনেক জিনিষ-পত্র সঙ্গে, বৃদ্ধ মহিলার মাথার সিথিতে বড় করে দেওয়া সিদূর। উঠতে দেরী হচ্ছে দেখে বাস ড্রাইভার জোরেই বলে উঠলেন – ‘কাকা, এত জিনিস নিয়া ভারত যাইতাসেন, সব তো ওই পারেই রাইখা আসবেন, খান এই পারে, রাখা আসেন ওই পারে’। কথাটা বলার পর দেখলাম বাসের অনেকেই হেসে দিলো। আমি আলো-আধারিতে লক্ষ্য করছিলাম উনাদের অপমানিত মুখ। কিছুক্ষণ বাস চলার পর, লক্ষ্য করলাম মহিলা সারির আঁচলে চোখ মুছেছেন। উনি আমার পাশেই বসেছিলেন, তাই জিজ্ঞাসা করলাম, কাঁদছেন কেন মাসীমা? উনি বললেন, ‘বাবা চোদ্দ পুরুষের ভিটা-মাটি ছাইরা চইলা যাইতাছি, ছেলেডাও মইরা গেলো, কেউ নাই, জমি-জিরাত লইয়া আর থাকবার পারলাম না।’ এরও অনেকদিন পর, জেনেভা শহরে ইন্টার্নশীপ করার সময় আমি প্রায়ই UNHCR HQ’র সামনে দিয়ে হেটে যেতে যেতে একটা বড় বিলবোর্ড লক্ষ্য করতাম যাতে খুব জ্বল-জ্বলে অক্ষরে লেখা থাকতো – There is no pain on Earth, then to lose one’s native land.
উত্সটা কোথায়?
কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার শুরুটা কোথায়? আমার মনে হয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শুরুটা কিছুটা নিজ এবং পরিবারের ভিতরেই আর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এবং সাম্প্রদায়িক হেনস্থা হয় রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতায়। রাজনীতি সেখানে একটা অনুসঙ্গ। আজকাল প্রায়ই একটা কথা শুনি, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে দাঙ্গা বাধানো হয়। কথাটা সত্যি কিন্তু এটাও তো সত্যি দাঙ্গা করার জন্য কিংবা তাকে বৈধতা দেবার মানসিকতাও তো কিছু মানুষ ধারণ করে। যদি সেই মানসিকতা থাকে তাহলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও থাকবে। মানসিকতা গুলো থাকে, আর রাজনীতি সেই মানসিকতাগুলোকে সংগঠিত করে। বিচারহীনতার পরিবেশ সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে আরো পরিপুষ্ট করে। এভাবেই চলে একটা দুষ্ট-চক্র। কোথায় যেন পড়েছিলাম – সাম্প্রদায়িক হয়ে যাওয়াটা খুব সহজ, কিন্তু সেক্যুলার, জাস্ট থাকাটা অনেক কঠিন – এটা প্রতিনিয়ত অনুশীলনের ব্যাপার, নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ার ব্যাপার। মানুষ যে সব সময় আডাম স্মিথের ‘rational self-interest’ অনুযায়ী কাজ করবে তা তো না। অনেকক্ষেত্রেই মানুষ সহজ প্রবনতাটাই বেছে নেই যদি না তার পারিবারিক শিক্ষা, রাষ্ট্রের শিক্ষা, ব্যক্তিগত শিক্ষা অন্য কিছু বুঝতে শিখায়। উপসনালয় গুলোতে কোন শিক্ষা বিতরণ করা হচ্ছে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে মানুষের আচরণ অনেক সময় স্ববিরোধীও হয়। দেখা গেল স্বাভাবিক অবস্থায় একজন আপাত উদার মানুষও কোনো সংকটের মুখোমুখি সাম্প্রদায়িক আচরণ করে বসলেন। আবার দেখা গেলো যৌবন কালে উদার, প্রগিতিশীল্ম রাজনীতি বিশ্বাস করা মানুষটি বিগত-যৌবনে কিংবা পৌরত্ত্বে বিভাজনের রাজনীতিতেই বিশ্বাস করেন। কবির সুমনের গানে যেমনটা আছে – ‘শোনো দারুন উদার-মনা, তুমি রাগতে রাগতে বলো, সুমন চাটুজ্যেটা শেষ-মেষ মুসলিম হলো’. আবার উল্টোটাও হয়। দেখা গেল সকলের চোখে খারাপ মানুষটাই দাড়িয়ে গেল প্রতিরোধে। পুরানো ঢাকায় একবার ভোটের পর মন্দিরে হামলা প্রতিরোধ করে একজন সন্ত্রাসী হিসাবে পরিচিত ব্যক্তি পরে জনপ্রিয় ওয়ার্ড কমিশনার হয়েছিলেন – এমন আমি দেখেছি। অবশ্যই ব্যক্তির প্রতিরোধ একটি পুরো সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে পারে না কিন্তু এটাই সত্যি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধের যে ইতিহাস তা হয়েছে ব্যক্তি এবং স্থানীয় পর্যায়ে।
এবং যা দেখা এবং শেখা
সামরিক শাসনগুলো
৮০’র দশকে বাংলাদেশের সামরিক সরকারের আমলগুলোতে আমাদের বেড়ে ওঠা। এখনো আবছা আবছা মনে আছে, এরশাদ ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর মেট্রিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে একটা হিন্দু ছেলে (বোধ হয় আশীষ কুমার কীর্তনিয়া নাম ) ফার্স্ট হলো। আমি কিন্তু হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এটা নিয়ে একটা আনন্দের প্রকাশ দেখেছি। তাদের ধারণা হিন্দু পরিবারের সন্তানরা মেধাবী হয়, পড়াশুনা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অনেক এগিয়ে থাকে (পরে বুঝেছি এগুলোও এক ধরনের সাম্প্রদায়িক চিন্তা) কিন্তু নানামুখী প্রশাসনিক বাধার কারণে তারা উপরে যেতে পারে না। তাদের ধারণা ছিল, যেহেতু তখন শাসন ক্ষমতায় একজন সামরিক আইন প্রশাসক- সেহেতু উনি কোথাও হস্তক্ষেপ করছেন না বলেই ছেলেটি প্রথম হতে পেরেছে। তবে তাদের এই আত্মতৃপ্তি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে রাষ্ট্র-ধর্ম ইসলাম করার মাধ্যমে সেই আশার বেলুন আবার চুপসে যায়। জিয়া’র আমলে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, পাকিস্তান, রাজাকার এইসব নিয়ে যে ফিস-ফিশানিটা ছিলো তা আবার ফিরে আসে। উত্কন্ঠিত অভিভাবক শ্রেনীর অনেককেই তখন বলতে শুনেছি – এদেশ বোধ হয় আর আমাদের জন্য না। ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যত না এই সংশোধনীতে অপমানিত হলো, তার চে বেশি দুঃখ পেলো বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রতিবাদ না আসায়।
এর আগেও সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ মূলনীতি সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু তখন যেটা বুঝতে পারি নি কিন্তু পরে উপলদ্ধি করেছি ধর্ম সংক্রান্ত সকল সংশোধনীর একটা সদূরপ্রসারী প্রভাব – সাম্প্রদায়িক বিষেদাগার এবং সাম্প্রদায়িক হেনস্থার প্রাতিষ্ঠানিক পুর্নবাসন – ফলাফল দেশের ১০% ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়ে অংশগ্রহনমূলক রাজনীতি করার পরিবর্তে, শুরু হয় তাদেরকে বাদ দেওয়ার রাজনীতি। এই বাদ দেওয়াটাই পরবর্তীকালে বিতারিত করায় পরিনত হয়। সেই ঘটনায় একটু পরে আসছি কিন্তু একটা ভুল ধারণা যে আজকাল অনেকেই বলেন, কেউ সংখ্যালঘু না, আমরা সবাই সমান এই দেশে। জানি এই চিন্তাগুলো সুনাগরিকতা প্রসূত, কিন্তু সংবিধানের এইসব সংশোধনী সেই ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে এইসব সংশোধনীর ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভিতরও যারা প্রগতিশীল চিন্তা করতেন তারাও দিনে দিনে কোনঠাসা হলেন। ছোটবেলা থেকেই কিছু কিছু পরিবারে দেখতাম তারা একটা লম্বা সময় ধরে পরিবারের কিছু সদস্য বাংলাদেশ আর কিছু সদস্য ভারতে অবস্থান করছে, হয়ত আসা-যাওয়া করছে, কিংবা একসময় হয়তো সবাই মিলে চলে গেলো, আবার কেউ কেউ হয়ত মাটি কামড়ে পরে থাকলো, গেলোই না। স্বাধীন বাংলাদেশে কেন এমন হচ্ছে? সেই কিশোর বয়সেই প্রশ্নগুলো মনে দোলা দিতো। সেই প্রশ্নের উত্তরগুলো আরও বড় হয়ে পেলাম যখন ১৯৯১ এবং ১৯৯৪ এ বাবরি মসজিদ ধ্বংস হবার পর পর বাংলাদেশে ব্যাপক হারে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হলো। সেই সময়টায় আমরা পুরানো ঢাকায় ছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছি, প্রথমবারের মত বোধ করলাম আমার একটা আইডেন্টিটি যেটা অন্যদের থেকে ভিন্ন তা আমার জীবনকে অনিরাপদ করে দেবার জন্য যথেষ্ট। অথচ তার আগে আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভারতে চলে যাবার প্রতিবাদ করেছি, পূজার মত ঈদের দিনেও একইভাবে উত্সবে মেতেছি, আমাদের মধ্যে বিরাজ করা কমন এলেমেন্ট গুলো নিয়ে কথা বলেছি।
তবু আমি ভাগ্যবান, আমার জন্ম, পড়াশুনা শহরে, মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি, উদার বন্ধুদের নেটওয়ার্ক আছে – আমার শ্রেণীই হয়তো আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের কিন্তু তা ছিলো না। আর দেশ ছাড়ার ব্যাপারটা এখন তো আর শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের ভিতর সীমাবদ্ধ নেই। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখন শিক্ষা, চাকরি, ইমিগ্রেশন, ব্যবসা নানা কারণেই বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন, স্থায়ী সেটেলমেন্ট গড়ে তুলছেন, অর্থ এবং অনান্য সম্পদ বিনিময় করছেন। কিন্তু আমি হয়ত আমার জীবন উন্নত করার জন্য স্বেচ্ছা মাইগ্রেশন নিয়েছি কিন্তু রাতের অন্ধকারে বিবাহ-যোগ্যা মেয়ে আর সহায়-সম্বল নিয়ে যে প্রৌড় মানুষটা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভিটে-মাটি ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে অনিশ্চয়তার দেশে তার জন্য এটা ফোর্সড মাইগ্রেশন। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফোর্সড মাইগ্রেশন একমুখী হয় – আর কখনই ফেরা হয় না।
তার পরের সময়গুলো
সামরিক শাসনামলের পর বাংলাদেশ যখন নির্বাচন কেন্দ্রিক দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফেরে তখন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আরেকটি পরীক্ষার ভিতর পড়ে। এবার শুরু হয় ভোটের রাজনীতি। ‘ভোটে দিয়েছো, ভোটে দিয়েছিস, ভোটে দিয়েছেন, ভোট মানুষের মুখে ব্যালট পেপার দেখছেন, নেতা দেখছেন, নেতা দেখছেন’ – একদমই এই গানটির মতই । একদিকে ভোট দেবার নাগরিক দায়িত্ব, অন্যদিকে ভোট কেন্দ্রে না যাবার হুমকি, অন্যদিকে ভোট কেন্দ্রে গেলে শুধু একজন প্রার্থীকেই ভোট দেবার হুঙ্কার যতটা থাকে, মূলধারার রাজনৈতিক দলের একজন প্রার্থী হিসাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ততটা মনোনীত দেখা যায় না। একটা প্রশ্ন প্রায়ই শুনতাম এবং আমার মাথায়ও আসতো – ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক থাকে। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম এই স্টেটমেন্টার ভিতর অনেক ফাকি-ঝুকি আছে। প্রথম বিষয় হলো, একজন ভিকটিম হিসাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের যে ভীতি সেটা দূর করবার জন্য কোনো রাজনৈতিক দল কথা এবং আচরণে সেভাবে এগিয়ে আসে নি, বরং তাদের ভীতিটা নিয়ে এক ধরনের রাজনীতি করা হয়েছে। সেই অর্থে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে অপসন ছিলো খুবই সীমিত। সেখানে তাদের দেখতে হয়েছে কে আজকেই তাকে আক্রমন করবে না কিংবা অন্তত ভোটের প্রয়োজনে হলেও আজকের টিকে থাকার নিশ্চয়তা দিবে। তাকে সমর্থন দিতে হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম বিদ্বেষপূর্ণ ব্যক্তি বা দলটিকে যদিও অনেকক্ষেত্রে সেই বিশ্বাসেরও মুল্য রাখা হয় নি। দ্বিতীয় কারণটি হলো রাজনৈতিক সংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ। মানুষ ভোটের আগে যখন দেখে সেই দলে তার সম্প্রদায় বা তার চিন্তার মানুষের অংশগ্রহন নেই, দলের গঠনতন্ত্রে বা নেতৃত্বে এমন কিছু আছে যেটা তার অংশগ্রহনকে নিরুত্সাহিত করবে কিংবা সাম্প্রদায়িক বিষেদগার কিংবা সাম্প্রদায়িক হেনস্থা যারা করেন তাদেরকে ক্ষমতায়ন করবে, তখন তার পক্ষে অপেক্ষাকৃত কম খারাপ অংশটি বেছে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মুক্তিযুদ্ধে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ এত বেশি নির্যাতিত, লাঞ্চিত হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কি এটাও তাদের সিদ্বান্তের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়। আজকাল অবশ্য ব্যক্তিও গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। একজন নেতা যিনি যেই রাজনৈতিক দলেরই হোক না কেন সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে তার অবস্থান যদি অপেক্ষাকৃত আন্তরিক হয় তাহলে তিনিও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট পাচ্ছেন। পুরানো ঢাকার একজন ওয়ার্ড কমিশনারের কথা যেমন বললাম। সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনেও এমন ঘটেছে বলে শুনেছি।
আর মূলধারার রাজনৈতিক দলে একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রার্থী হলে আর অন্যানরা ধর্মীয় সংখ্যাগুরু হলে ভোটের রাজনীতি তখন সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। নির্বাচনের রাজনীতিতে বিভিন্ন স্লোগান এবং পোস্টারে আমি ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িক বিষেদাগার করতে দেখেছি। হিন্দুদের দেব-দেবী নিয়ে কুত্সিত, বিকৃত পোস্টের এই ঢাকা শহরেই আমি দেখেছি। পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিসনের আচরন-বিধি সেই ধারাকে কিছুটা বন্ধ করে। ভোটের পর সাম্প্রদায়িক হামলা এখন আরেকটি নিয়মিত অনুসঙ্গ। ২০০১ সালে নির্বাচনত্তর সহিংসতা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের একটা বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে। ২০০১ এবং ২০১৩ সালে নির্বাচন উত্তর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে নিরাপত্তা দানের ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব কোনোভাবেই রাষ্ট্র এবং সেই সময়ের ক্ষমতাসীন সরকার এড়াতে পারবেন না। জাতিসংঘের ‘Declaration on the Rights of Persons Belonging to National or Ethnic, Religious and Linguistic Minorities’ এবং ‘Draft Minority Declaration’ একটা কথা খুব পরিষ্কার ভাবে বলেছে – nation-state as the sole source of all laws and regulations that govern the relationship between majorities and minorities.
বিচারহীনতা এবং রাষ্ট্র
লক্ষ্য করে দেখবেন বিচারহীনতার কথা আমি এখানে বারবার বলেছি। আমি সাম্প্রদায়িকতার সকল ঘটনাকেই এখন সুশাসনের অভাব এবং বৃহত্তর বিচারহীনতার প্রেক্ষাপটের একটা অংশ বলেই মনে করি। ঘটনার সময় সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করে নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করা, আগে সচেতনার মাধ্যমে সম্প্রীতির আবহাওয়া তৈরী করা এবং পরে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এবং হেনস্থার মত ঘটনাবলির বিচারের ব্যবস্থা করার মত কতগুলো সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব আছে রাষ্ট্রের। আজ পর্যন্ত কোনো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের কোনো দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি বাংলাদেশে। সেটা খুব বড় একটা শুন্যতা। যে রাজনীতি রাষ্ট্রকে এই জবাবদিহিতার ভিতর আনতে বাধা দেয় সেই রাজনীতিই আসলে সাম্প্রদায়িকতাকে টিকিয়ে রাখে।
আজ এত্তদিন পরে এসে যেটা বুঝতে পেরেছি সংখ্যালঘু আসলে কিছু অধিকার বঞ্চিত মানুষ, সেটা সব ধর্মে, সব দেশেই আছে।
Partha Sarker writes on various social and technology issues, with a belief in cultural activism.
I would love to read your posting, if possible, in English. Thank you.