টিনেজ যৌনকর্মীদের ছবি প্রকাশ, দারিদ্র্যতা শো করা ছাড়া অন্য কিছু না – মৃদুল শাওন
ফেসবুকে কয়েকজনরে দেখলাম একটা লিঙ্ক শেয়ার দিতাছে। ‘BuzzFeed’ নামের একটা আমেরিকান ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের টিনেজ-যৌনকর্মীদের তিরিশটা ছবি। শিরোনাম- “30 Tragic, Beautiful Photos Of Teenage Prostitutes In Bangladesh”।
যৌনকর্মীদের ‘ট্র্যাজিক’ জীবনরে তুইলা আনতে যাইয়া তারা মানে ‘BuzzFeed’ নান্দনিকতার কথা ভুইলা যান নাই, তাই ‘বিউটিফুল ফটোজ’।
ছবির বিষয় ‘ট্র্যাজিক’ হইলেও ফটোগ্রাফি সুন্দর। ‘BuzzFeed’ নিশ্চয়ই ফটোগ্রাফির ‘নন্দন’ বুঝতে পারা মানুষদের কথা ভাইবাই রাখছে এই শিরোনাম। গরীব মানুষরে ছবির সাবজেক্ট বানানো নতুন কিছু না। ফটোগ্রাফি দিয়া গরীবের প্রাইভেসির বারোটা বাজানো বেশ পুরাতন ফ্যাশান।
প্রাইভেসির কথা বাদ দিলাম। ধরলাম এই ছবিগুলা সাবজেক্টদের অনুমতি নিয়াই তোলা হইছে। এই ছবিগুলাতে যৌনকর্মীদের ঘর, তাদের মেকাপ নেওয়া, যৌনকর্মীর বাচ্চা, তাদের ভাত খাওয়া, গোসল করা, গ্রাহকদের সাথে তাদের অন্তঃরঙ্গতা ইত্যাদি ইত্যাদি তাদের লাইফস্টাইল দেখাইয়া দুনিয়ারে কি দেখানো হইলো? গরীবের যৌনতা নাকি যৌনতার গরীবত্ব?
আমেরিকায় বা উন্নত বিশ্বে কি চাইল্ড প্রস্টিটিউশান নাই? আছে এবং সেইখানেও নিশ্চয়ই দারিদ্র্যের কারণেই এইটা ঘটে। এইটা কি শুধু বাংলাদেশ বা গরীব দেশগুলির সমস্যা? তা অবশ্যই না। কিন্তু সেইসব দেশে তাদের গরীবরাও যেহেতু দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকে না, তাই সেইখানে এইটারে তারা অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মতই দেখে। বাংলাদেশ বা অন্যান্য গরীবদেশের দারিদ্র্য যেহেতু তাদের শো করার একটা সাবজেক্ট, তারা এই সুযোগটা নেয়।

বিদেশী আলোকচিত্রীরা বা বিদেশে দেখানোর জন্য দেশী আলোকচিত্রীরা এবং ডকুমেন্টারী নির্মাতারা দারিদ্র্য শো করে সামাজিক সমস্যা দেখানোর নাম কইরা। দারিদ্র্যও সামাজিক সমস্যা। তবে তাদের দেখানোতে সমস্যা আর দেখা যায়না, তা দারিদ্র্যের বিজ্ঞাপন হইয়া উঠে।
বড়লোকদের বড়লোকি শো করা অথবা দরিদ্রদের দারিদ্র্য শো করা আর বড়লোক বা মধ্যবিত্ত দ্বারা দরিদ্রের দারিদ্র্য শো হওয়া নিশ্চয়ই এক না। বড়লোক বা মধ্যবিত্ত যখন গরীবের ‘গরীবত্ব’ শো করার দায়িত্ব নেয়, তখন সেইটা হয় করুণা নাইলে ঠাট্টা। ‘BuzzFeed’ ওয়েবসাইটের এই কাজে করুণা-ই দেখা যাইতেছে। এবং সেই করুণা ‘BuzzFeed’ এর ভিজিটর বা রিডারদের মধ্যেও সঞ্চারিত হইতেছে।
‘BuzzFeed’ এর জন্য রয়টার্সের বাংলাদেশের ফটোসাংবাদিক অ্যান্ড্রু বিরাজ ছবিগুলা মনে হয় সাবজেক্টদের অনুমতি নিয়াই তুলছেন।
বেশ্যাদের ঘরবাড়ি আর জীবনের ছোটগল্প সম্ভোগ করা এবং সেই সম্ভোগ দুনিয়ারে দেখানো যাইতেই পারে। যেহেতু গরীবের প্রাইভেসি-বোধ বড়লোক বা মধ্যবিত্তের মত না । কিন্তু গরীবরে যখন ম্যাটেরিয়ালের সাবজেক্ট বানাইয়া তারে এবং তার তথ্য দুনিয়ারে জানানো হইল, এই জানানোতে গরীবের হয়তো আপত্তি নাই। কিন্তু তার প্রকাশিত হওয়ার আগেই তারে প্রকাশিত কইরা ফালানো হইল। এইটা অসম্মান। গরীবরে এই অসম্মান যত সহজে করা যায়, মধ্যবিত্ত বা বড়লোক রে তা করা যায়না।
গরীবরা আপত্তি করেনা বইলাও, এই আলোকচিত্রী বা ডকুমেন্টারীওয়ালারা এইটারে নিজেদের অধিকার ভাইবাই তো থাকে।
এইদেশে কি মধ্যবিত্ত বা বড়লোক যৌনকর্মী নাই? তাদের জীবনযাত্রা কি এইভাবে দেখাইতে পারবে কোনো ফটোগ্রাফার বা ডকুমেন্টারীওয়ালারা?
তা তারা পারবে না, কারণ এই অনুমতি তাদের দেওয়া হবে না। কিন্তু গরীবের বেলায় যেহেতু অনুমতি নিয়া বা অনেক ক্ষেত্রে অনুমতি ছাড়াই এইটা করা যায়, তাই তারা গরীবরে ‘গরীব’ দেখানোর সুযোগটা নিবে আর কি!
অপরিচিত গরীবরে তারা যেভাবে ছবির সাবজেক্ট বানায়, অপরিচিত মধ্যবিত্তের বেলায় এইটা সম্ভব হয় না। আর এই সাবজেক্ট বানানোর পিছনেও থাকে তাদের ‘গরীবত্বে’র কারণে যে করুণা জন্মায়, তা।
তাদের দারিদ্র্য শো করার উদ্দেশ্য পূরণ হয়। গরীবের প্রাইভেসি নাই। প্রাইভেসি নিয়া তারা ভাবিতও না। তাই বইলা ফটোগ্রাফার বা ডকুমেন্টারীওয়ালারা কেন গরীবের জীবন,সংস্কৃতি সাবজেক্ট বানাইয়া শো করারে দায়িত্ব বা অধিকার মনে করবে?
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেমন গরিবত্ব ঘোচানোর জন্য সচেষ্ট, তেমনি গরীবত্ব রাইখা দিতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সচেষ্ট। উন্নত রাষ্ট্র যখন গরীব রাষ্ট্ররে চিরকাল সাহায্য দিয়া এবং একইসাথে গরীবত্ব শো কইরা সাহায্যপ্রার্থী কইরা রাখতে চাইবে তখন গরীবরাও কি তাদের এই সাহায্য গ্রহণ করতে করতে গরীব থাকতেই চাইবে? গরীবের কাজ কি তাইলে এনজিও আর অ্যাকটিভিস্টদের সহায়তা কইরা যাওয়া?
গরিবের গরীবত্ব ঘোচানোর প্রকল্পে গরীবরে যেমন শুধু একটা ‘গোষ্ঠী’ হিসাবেই দেখা হয়, ধনীদের এইভাবে সামগ্রিক একটা ‘গোষ্ঠী’ হিসাবে দেখা হয়না। কারণ গরিবত্ব যতটা সামাজিক সমস্যা বইলা তারা জ্ঞান করে, ধনীত্বরে তা করে না। ধনীদের সামগ্রিকভাবে শুধু তখনই দেখা হয়, যখন তারা গরীবের বিপরীতে একটা শ্রেণী।
ফটোগ্রাফার যখন যেকোনো গরীবের ছবি তোলে তখন একটা ‘গোষ্ঠী’ হিসাবেই তোলে। মানে, যেকোনো গরীবের ছবি মানে গোষ্ঠী ‘গরীব’ এর ছবি। এর পিছনে থাকে – যে গরীবরা কেন এইভাবে জীবন কাটাইতেছে, গরীবরা কেন আলু খাইতেছে, হায়াল্লা গরীবের বাচ্চা কত বুদ্ধিমানের মত কথা বলে। যেন গরীবের এইগুলার কোনোটা করার কথা না।
যেন গরীবের জীবন তার নিজের জীবন না, পরিস্থিতির জীবন।
ফিকশনাল আর্টে গরীবরে ব্যবহার করা আর ফটোগ্রাফিতে সাবজেক্ট করা আলাদা ব্যাপার। ফটোগ্রাফিতে গরীবের ‘পার্সোনালিটি’রে তুচ্ছ করা হয়, বিশেষ কইরা যেসব ফটোগ্রাফ রচিত হয় অ্যাক্টিভিজমের দায় মিটাইতে।
অ্যাকটিভিস্ট এবং গরীবের রাজনৈতিক অবস্থান তো ফিক্সড হইয়াই আছে, সেই রাজনীতিই এইখানে কাজ করে। দর্শক বা অন্য কারো রাজনৈতিক অবস্থান এইখানে খুব একটা প্রাসঙ্গিক না।
এইদেশের গরীব যৌনকর্মীদের চাইতে এইদেশের সাধারণ গরীবদের জীবন কি কম ট্র্যাজিক? বা এইদেশের সাধারণ গরীবদের চাইতে এইদেশের গরীব যৌনকর্মীদের জীবন কি বেশি ট্র্যাজিক? টিনেজ প্রস্টিটিউটদের জীবনযাত্রার ‘বিউটিফুল ফটোজ’ দেখানোর মাধ্যমে ‘BuzzFeed’ বা তাদের দারিদ্র্য শো করার, সাবজেক্ট বানানোর উদ্দেশ্য পূরণ হয়। এবং যারা শেয়ার করে তাদের বিবেকের শখও পূরণ হয়। বর্তমান ও ভবিষ্যতের গরীব এবং টিনেজ যৌনকর্মীদের তাতে কি যায় আসে?